নব্বইয়ের দশকের একদম শুরুর দিকের কথা। জার্মানির দুই অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ইতালির আল্পস পর্বতমালায় গিয়েছেন হাইকিং করতে। পর্বতের চূড়া থেকে নামার সময় তারা প্রচলিত পথ থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছিলেন। নিচের দিকে নামতে নামতে হঠাৎ তারা বরফ গলিত পানির মধ্যে একটি নগ্ন মৃতদেহ দেখতে পান। প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও তারা ছিলেন মূলত অভিজ্ঞ পর্বতারোহী। তাই তারা এগিয়ে গিয়ে ঘটনাটা বুঝার চেষ্টা করলেন। আল্পসের বরফের মধ্যে এমন একটা দেহ খুঁজে পাওয়া যে একটা বিরল ঘটনা, সেটা তারা জানতেন। অনেক সময় বিশাল বিশাল বরফের খণ্ডে ফাটল তৈরি হয়। আর সেই ফাটলের মধ্যে কোন মানুষ পড়ে গেলে আর উঠতে পারে না। তারা ধারণা করলেন যে- এই দেহটা হয়ত পাঁচ বা দশ বছরের পুরনো হবে। এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াতে বরফ গলে দেহটা হয়ত বছর দশেক পরে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
পরের দিন আরও দুইজন পর্বতারোহী ঐ জায়গাটা ঘুরে দেখতে আসেন। এই নতুন দুই ভদ্রলোক ঐ দেহটার পাশে খুবই অদ্ভুত একটি জিনিস দেখতে পান। জিনিসটার নাম আইস-পিক। ইউরোপে প্রায় ২০০ বছর আগে লোহার তৈরি ছুঁচালো এই জিনিসটা খুব প্রচলিত ছিল। বিশাল বিশাল বরফের চাই ভাঙতে এগুলো ব্যবহার করা হতো। পুরনো আমলের আইস-পিকের মত একটা জিনিস মৃতদেহের পাশে দেখতে পেয়ে তারা বেশ অবাকই হয়েছিল। এরপর এই ঘটনা পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ তাদের ফাইল-পত্র চেক করে আন্দাজ করে যে- এই দেহটা সম্ভবত কার্লো কাপসোনি নামের এক ইতালীয় প্রফেসরের। তিনি ১৯৪১ সালে এই অঞ্চলের কাছাকাছি হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারলেন যে, ঐ লোহার বস্তুটা আসলে কোন আইস-পিক জাতীয় কোনো জিনিস নয়। এটা মূলত প্রাগৈতিহাসিককালের একটা কুঠার।
দেহটার পাশে ঐ কুঠার ছাড়াও আরেকটি জিনিস পাওয়া গিয়েছিল। কিছুদিন পর সবাই বুঝতে পারল যে, সেটা বার্চ গাছের বাকল দিয়ে তৈরি একটা পাত্র। এই ধরনের জিনিস আধুনিককালের কোনো মানুষ ব্যবহার করে না। ধীরে ধীরে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল- এই দেহটি শত বছর আগের নয়, বরং মানুষটি হয়ত হাজার বছর আগের! এই পর্যায়ে এসে ঘটনাটা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা আন্তর্জাতিক খবর হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর গবেষণার জন্য দেহটিকে অষ্ট্রিয়ার একটি ফরেনসিক গবেষণাগারে নিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। বিজ্ঞানীরা চেয়েছিলেন দেহটি থেকে DNA নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে দেখতে। পুরনো কোনো দেহ থেকে DNA বের করে গবেষণার ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট ব্রায়ান সাইকস ছিলেন ঐ সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী। ফলে তার ডাক পড়ল। কিন্তু এত পুরনো একটি দেহ থেকে DNA সংগ্রহ করে সেটা বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন একটি কাজ। সেসময় বিজ্ঞানের এই শাখাটা সবে শুরু হয়েছে। তাই কাজটি আসলেই করা সম্ভব হবে কিনা সেটা নিয়েও একটা সন্দেহ ছিল। কারণ এর মধ্যে দেহটির কার্বন ডেট টেস্ট করা হয়ে গেছে। আর ফলাফল যা জানা গেছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। এই মানুষটি আসলে ৫০০০ থেকে ৫৩৫০ বছর আগে বেঁচে ছিলেন!
এত পুরনো একটি দেহ থেকে এর আগে DNA বের করে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই দেহটার ক্ষেত্রে ব্রায়ান সাইকস অনেক আশাবাদী ছিলেন। কারণ দেহটা পুরোটা সময়ই অনেক গভীর বরফের নিচে ঢাকা ছিল, ফলে তরল পানি দেহে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই কাজটা সফল হওয়ার বড় ধরনের সম্ভাবনা আছে। পানি আর অক্সিজেনই মূলত DNA টা নষ্ট করে ফেলে।
শেষ পর্যন্ত ব্রায়ান সাইকসের ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হলো। মৃতদেহটির হাড় থেকে তারা যথেষ্ট পরিমাণ DNA বের করতে পারলেন। সাইকসের টিমের পাশাপাশি মিউনিখ থেকে আসা আরকটি বিজ্ঞানীদের দলও একই DNA নিয়ে বিশ্লেষণ করলেন। আর দুই টিমের বিশ্লেষণ থেকেই একই ফলাফল পাওয়া গেল। সেই ফলাফল তখন “সায়েন্স” জার্নালে প্রকাশ করা হলো।
কিন্তু কী পাওয়া গিয়েছিল সেই DNA বিশ্লেষণ করে?
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মৃতদেহটির DNA সিকোয়েন্স বর্তমানে ইউরোপে বাস করা মানুষদের DNA সিকোয়েন্সের সাথে একদম হুবহু মিলে যায়। তার অর্থ হলো- এই লোকটি নিশ্চিতভাবেই ইউরোপিয়ানদের সরাসরি পূর্বপুরুষ। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় খবর বের হতে থাকল। আর সাংবাদিকরাও এসে গবেষক দলকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলেন। সাইকসের কাছে যেসব সাংবাদিক এসেছিলেন তিনি তাদের যথাসম্ভব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এই সাংবাদিকদের মধ্যে সানডে টাইমসের লোইস রজার্স একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে বসলেন।
তার প্রশ্নটা ছিল, “আপনারা তো বলছেন যে বরফের মধ্যে পাওয়া মানুষটার DNA আজকের দিনের ইউরোপিয়ানদের সাথে হুবহু মিলে যায়, কিন্তু কারা এই ইউরোপিয়ান?”
এই কথা শুনে সাইকস একটু ভড়কে গেলেন। এ আবার কেমন প্রশ্ন! সাইকস বললেন, “কারা বলতে আপনি আসলে কী বুঝাতে চাইছেন? আমাদের কাছে যেসব ইউরোপিয়ানদের DNA স্যাম্পল আছে আমি তাদের সাথে মিলের কথা বলেছি। এই কালেকশনে ইউরোপের সব অঞ্চলের মানুষের DNAই আছে।”
এই উত্তর দিয়েও সাংবাদিক সাহেবকে সন্তুষ্ট করা গেল না। তার পালটা প্রশ্ন, “সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু কার DNA এর সাথে মিলেছে, তার নাম বলেন, আমরা জানতে চাই!”
এবার সাইকস বললেন, “সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কারণ এইসব DNA স্যাম্পল দেওয়ার সময় প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য আলাদা আলাদা ফাইলে রাখা হয়। আর সেই তথ্যগুলো গোপনীয়। সবার কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার মত নয়।”
লোইস চলে গেলে সাইকস তার কম্পিউটারটা দ্রুত চালু করলেন। ঠিক কোন কোন স্যাম্পল এই বরফ মানবের DNA এর সাথে ম্যাচ করে সেটা দেখার জন্য তার খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সার্চ করে দেখা গেল বেশ কয়েকটি ফাইলের সাথে LAB 2803 নামের একটি ফাইলও এই বরফ মানবের DNA এর সাথে ম্যাচ করছে। ফাইলের নামের আগে “LAB” থাকার অর্থ হলো- এই ফাইলের DNA ডোনার হয় সাইকসের ল্যাবেই কাজ করেন, নয়তো এই ল্যাবেরই কোন এক কর্মকর্তার কোন বন্ধু বা আত্মীয়। ফাইল খুলে দেখা গেল LAB 2803 নমুনার ডোনারের নাম মেরি মোজলি। এই মেরি সাইকসেরই বন্ধু, ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তবে অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। মেরির DNA এর সাথে এই বরফ মানবের DNA একদম হুবহু ম্যাচ করে। তার একটাই অর্থ দাঁড়ায়- পাঁচ হাজার বছর পুরনো এই মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই মেরির আত্মীয়। এই বরফ মানবের মায়ের থেকে শুরু করে মেরি পর্যন্ত একটা আনব্রোকেন জেনেটিক লিঙ্ক আছে। অর্থাৎ, বরফ মানব আক্ষরিক অর্থেই মেরির পূর্বপুরুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায় যে- এই বরফ মানব মেরির মায়ের দিকের পূর্বপুরুষ। DNA বিশ্লেষণের সাহায্যে মায়ের দিকের বংশধারা বের করার একটা দারুণ পদ্ধতি আছে। এজন্য মাইট্রোকন্ড্রিয়ার মধ্যে থাকা DNA বিশ্লেষণ করতে হয়।
আমাদের DNA থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। তবে নিউক্লিয়াস ছাড়াও মাইট্রোকন্ড্রিয়ার মধ্যেও ছোট এক টুকরো DNA থাকে। এই DNA টা আমরা শুধু মায়ের কাছ থেকে পাই। ফলে এই মাইট্রোকন্ড্রিয়াল DNA এর সাহায্যে মায়ের দিকের পূর্বপুরুষ বা বংশধারা নির্ণয় করা যায়।
মাইট্রোকন্ড্রিয়াল DNA টা সন্তানেরা শুধু মায়ের কাছ থেকেই পায়। শুক্রাণু এবং ডিম্বানু দুইটির মধ্যেই মাইট্রোকন্ড্রিয়া থাকে। তবে ফার্টিলাইজেশন বা নিষিক্তকরণের সময় একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। শুক্রাণুর মধ্যে cps-6 নামে একটি জিন থাকে, আর এই জিনটির কাজ হলো একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুক্রাণুতে থাকা মাইট্রোকন্ড্রিয়াটা ভেঙে ফেলা। ফলে সন্তান আর বাবার মাইট্রোকন্ড্রিয়াল DNA টা পায় না। আর ঠিক এই কারণেই মাইট্রোকন্ড্রিয়াল DNA থেকে মায়ের দিকের বংশের ধারাবাহিকতা বের করা যায়।
বরফ মানবের সাথে মেরির এই আত্মীয়তার সম্পর্ক বের হবার পর সেই নিউজ প্রথমে সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মেরি রীতিমতে আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। কিন্তু প্রফেসর অবাক হলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করে। তিনি খেয়াল করেছিলেন যে, জেনেটিক লিঙ্ক বের হওয়ার পর থেকে মেরি এই পাঁচ হাজার বছর আগের নামহীন একটা মানুষকে বলতে গেলে তার নিকট আত্মীয় ভাবতে শুরু করেছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে- এই বংশের বিষয়টি মানুষের মনে কতটা প্রভাব ফেলে। এরপর তার মাথায় আরও একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি পাঁচ হাজার বছর আগের একজন মানুষকে মেরির পূর্বপুরুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়, তার মানে আমাদের প্রত্যেকরই এমন হাজার হাজার বছর আগের পূর্বপুরুষদের খোঁজে বের করা যাবে ! কথাটা অসম্ভব শোনালেও তাত্ত্বিকভাবে কাজটা খুবই সম্ভব।
এই বিষয়টি তিনি তখন তার কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছিলেন। কিন্তু তারা তার কথার অর্থই সে অর্থে বুঝতে পারেনি। কিন্তু প্রফেসর সাইকস কিন্তু থেমে থাকলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রাচীনকালের মানবদেহ যেমন এই গবেষণায় কাজে আসবে, তেমনি বর্তমানের জীবিত মানুষদের DNA’ও এই গবেষণায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তিনি প্রায় দশ বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়েই গবেষণা করে গেছেন। তার গবেষণায় যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য! প্রাচীনকালের বিভিন্ন নমুনা এবং আজকের দিনের হাজার হাজার মানুষের DNA নিয়ে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পেলেন যে- আজকের দিনে যে ৬৫০ মিলিয়ন ইউরোপিয়ান বেঁচে আছে, তারা প্রত্যেকেই সাতজন মহিলার বংশধর। আপনি যদি ইউরোপের যে কোনো দেশ থেকে যে কোনো র্যানডম একজন মানুষের DNA নিয়ে পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে- তিনি এই সাত জনের যে কোনো একজনের বংশধর! অর্থাৎ, এরাই হলেন ইউরোপের সকল মানুষদের আদিমাতা। প্রফেসর সাইকস এদের নাম দিয়েছেন “The Seven Daughters of Eve”।
এই যে সাতজন মহিলার কথা বলা হচ্ছে, যাদের বংশধারা থেকেই আজকের দিনের সব ইউরোপীয় মানুষদের জন্ম হয়েছে- তাদেরকে প্রফেসর সাইকস নাম দিয়েছেন ক্ল্যান মাদার বা গোত্রমাতা। জেনেটিক্সের ভাষায় এই গোষ্ঠীদের বলা হয় মাইট্রোকন্ড্রিয়াল হ্যাপলোগ্রুপ। সহজে মনে রাখার জন্য প্রফেসর সাইকস এই হ্যাপলোগ্রুপগুলোর আদিমাতাদের একটি করে নাম দিয়েছেন। যেমন হ্যাপলোগ্রুপ ইউ (Haplogroup U) এর আদিমাতার নাম দিয়েছেন উরসুলা, হ্যাপলোগ্রুপ এইচ (Haplogroup H) এর আদিমাতার নাম দিয়েছেন হেলেনা, হ্যাপলোগ্রুপ টি (Haplogroup T) এর আদিমাতার নাম দিয়েছেন টারা। প্রফেসর সাইকসে নিজে হলেন টারার বংশধর।
এই টারা নামের ভদ্রমহিলা বাস করতেন উত্তর ইতালিতে, আজ থেকে প্রায় ১৭ হাজার বছর আগে।
একটা জিনিস জেনে রাখা দরকার- এই আদিমাতারা কিন্তু একই সময়ে জীবিত ছিলেন না। কেউ হয়ত ১৭ হাজার বছর আগের মানুষ, আবার কেউ হয়ত জীবিত ছিলেন আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে।
শুধু এই সাত জন গোত্রমাতাই নয়, আমরা চাইলে মাইট্রোকন্ড্রিয়াল DNA থেকে আরও আগের ইতিহাস বের করতে পারি। পরবর্তীতে জেনেটিসিস্টরা হিসাব করে দেখেছেন যে, আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলে এক মহিলা বাস করতেন, তিনি হলেন আজকের পৃথিবীর জীবিত সব মানুষের আদিমাতা! জেনেটিক্সের ভাষায় এই আদিমাতাকে বলা হয় mt-MRCA, অর্থাৎ মাইট্রোকন্ড্রিয়াল মোস্ট রিসেন্ট কমন এনসিস্টর। কিন্তু সহজে বোঝার সুবিধার্থে এই আদিমাতা এখন মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভ (Mitochondrial Eve) নামেই বেশি পরিচিত। বাইবেল অনুসারে “ইভ” যেহেতু পৃথিবীর সকল মানুষের আদিমাতা, তাই সহজে বোঝার স্বার্থে কোনো এক সাংবাদিক এই “মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভ” নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। কিন্তু এই টার্মটি এখন এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে বিজ্ঞানীরাও mt-MRCA কে অনেক সময় মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভ বলেই উল্লেখ করেন।
এটাতো গেল মায়ের দিকের বংশধারা। ম্যাটারনাল লাইনের মত বাবার দিকের অর্থাৎ প্যাটারনাল লিংকও কী বের করা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ।
মাইট্রোকন্ড্রিয়া যেমন আমরা শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে পাই, তেমনি Y ক্রোমোজোমের DNA টা আমরা শুধু বাবার কাছ থেকেই পাই। Y ক্রোমোজোম শুধুমাত্র বাবা থেকে ছেলেরা পায়। Y ক্রোমোজোমের জেনেটিক লিঙ্ক থেকে যে আদিপিতা পাওয়া যায় তাকে বলা হয় “Y ক্রোমোজমাল এডাম”। এই লোকটিও বাস করতেন আফ্রিকাতে, আজ থেকে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। এই লোকটি হলেন আজকের পৃথিবীতে বাস করা প্রতিটি লোকের আদিপিতা।
এই DNA বিশ্লেষণের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে আসলে হাজার বছর নয়, বরং লক্ষ বছরের অতীত ইতিহাসকে উদ্ধার করা যাচ্ছে। আমরা যদি মাত্র ৫০০০ বছর আগে চলে যাই, তাহলে লিখিত ইতিহাসের আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই ৫০০০ বছর আগের যে কোনো কিছুকেই বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা। এর আগের কোনো কিছু জানতে হলে আমাদের প্রাচীনকালের মানুষদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ বা জিনিসপত্রের উপর নির্ভর করতে হবে। আর আমরা যদি আরও আগের কোনো ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই তাহলে সেক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ১২০০০ বছরের আগে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। ফলে এই সময়ের আগের তেমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আমরা যদি ৪০ হাজার বছরের আগে চলে যাই, তাহলে আর গুহাচিত্র বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আধুনিক জেনেটিক্স এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে যার সাহায্যে হাজার নয়, বরং লক্ষ বছর আগের ইতিহাসও উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিটা সম্ভব হচ্ছে মূলত “এনসিয়েন্ট ডিএনএ টেকনোলজি” এবং “পপুলেশন জেনেটিক্স” নামে দুইটি শাখার দারুণ উন্নতির ফলে।
অবাক করার মত বিষয় হলো, এই দুই নতুন বিজ্ঞানের সাহায্যে কিন্তু শুধু পূর্বপুরুষদেররা কত দিন আগে বাস করত সেটাই জানা যায় না। বরং এই মানুষগুলো সংখ্যায় কত ছিল, তারপর ধরুন- তারা কোন অঞ্চল দিয়ে কোন অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল সেটাও জানা যায়। আজ থেকে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে যখন “Y ক্রোমোজমাল এডাম” বেঁচে ছিলেন, তিনি কিন্তু একা বাস করতেন না। ঐ অঞ্চলে তখন যতজন প্রজননক্ষম মানুষ ছিলেন সেই সংখ্যাকে বলা হয় “এনসেস্ট্রাল পপুলেশন”। DNA বিশ্লেষণের সাহায্যে এই “এনসেস্ট্রাল পপুলেশন” এর সংখ্যাও বের করে ফেলা যায়। এমনকি প্রাচীন মানুষরা কত বছর আগে কোন অঞ্চল দিয়ে এশিয়া বা ইউরোপে প্রবেশ করেছিল DNA বিশ্লেষণের সাহায্যে সেটাও বের করা যায়!
মানুষের DNA বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে- আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে ১ হাজার জনেরও কম মানুষের একটা দল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পরে। পরবর্তীতে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। আজকের দিনে আফ্রিকার বাইরে যত লোক বাস করে, তারা সবাই ঐ ছোট্ট দলটিরই বংশধর। কথাটা শুনতে আশ্চর্যজনক মনে হলেও এটাই আমাদের DNA বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে। ৫০ হাজার বছর আগে কেউ ইউরোপিয়ানদের মত সাদা চামড়া বা নীল চোখের ছিল না। এই বৈশিষ্ট্যগুলো আরও পরে কিছু বিশেষ মিউটেশনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।
ইতালির সেই বরফ মানবের DNA বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রফেসর ব্রায়ান সাইকস কীভাবে ইউরোপের সাতজন আদিমাতা সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িয়ে গেলেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করে সাইকস একটি বই লিখেছেন। এই বইতে জেনেটিক্স এবং DNA বিশ্লেষণের অনেক খুঁটিনাটি দিক উঠে এসেছে। আফ্রিকা থেকে প্রাচীন মানুষরা কীভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, বা কীভাবে মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভের গবেষণা হলো- এসবও উঠে এসেছে এই বইতে। বইটির নাম – The Seven Daughters of Eve: The Science That Reveals Our Genetic Ancestry। জেনেটিকস এবং মানুষের আদিম ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী যে কারও জন্য বইটি একটি অবশ্যপাঠ্য। এই বই পড়লে একদিকে যেমন বিজ্ঞান জানা হবে, তেমনি প্রফেসর ব্রায়ান সাইকসের গবেষণার গল্পগুলোর সাথেও পরিচয় ঘটবে। বইয়ের শেষের দিকে এই সাতজন আদিমাতারা কিভাবে জীবনযাপন করতে সেই বিষয়টাও ফিকশনের মত করে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধরনের বইকে তাই অনেক ক্ষেত্রে সেমি ফিকশনাল বই বলা হয়।