কিছু কিছু ঘটনা শুনলে আপনার মনে হতে পারে যে- মানুষের জীবনে আসলেই অভিশাপ নেমে আসতে পারে। ছেলেটির নাম ডেনিয়েল। জন্মের সময় তার হাত-পা ছিল তুলার মতো নরম। এমনকি সে হাত-পা নাড়াতে পর্যন্ত পারত না। তার উপর ছিল শ্বাস নেওয়ার সমস্যা। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো। অনেক দিন ICU তে রাখার পর ডেনিয়েল সুস্থ হতে থাকে এবং নিজে নিজেই শ্বাস নিতে শুরু করে। কিন্তু সুস্থ হলেও দেখা গেল সে অন্যসব বাচ্চার মত লিখতে, পড়তে বা মনে রাখতে পারে না।
ডেনিয়েলের মা সারাহ তাকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখত। ওর মায়ের বয়স যখন ৩৫ এর মত, তখন এই মহিলার অদ্ভুত কিছু সমস্যা হতে শুরু করে। তার হাতের মাংসপেশি এতই শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি হাত দিয়ে কোনোকিছু ধরতে পারতেন না, আর একবার ধরলে সেটা ছাড়াতেও পারতেন না। এরপর মাত্র ৪২ বয়স বয়সে তিনি হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মারা যান। এরপর ডেনিয়েলের দায়িত্ব এসে পরে তার নানির কাঁধে। তবে তার নানিও সুস্থ ছিলেন না। মাত্র ৫০ বছর বয়সেই তার চোখে মারাত্মক ছানি দেখা দেয়।
এই পরিবারের কাহিনী শুনে মনে হতে পারে যে- একটি রোগের সাথে অন্যরোগগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন যে- এই ধরনের সমস্যা শুধু একটি পরিবারে নয়, বরং সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক পরিবারেই এই ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রথম প্রজন্মের চোখে ছানি, দ্বিতীয় প্রজন্মের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া ও হৃদপিণ্ডের অসুখ, আর তৃতীয় প্রজন্মে এসে ডেনিয়েলের মত অনেকগুলো অস্বাভাবিক রোগ। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে- আমাদের DNA এর মধ্যে থাকা মাত্র একটি জিনে যদি কোন কারনে মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়, তবে এই রোগ দেখা দেয়। এই রোগের নাম হলো মায়োটনিক ডিস্ট্রফি (Myotonic Dystrophy)।
এই DNA জিনিসটি কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে- এর মধ্যে সামান্য কোনো পরিবর্তন হলেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম জটিল সব রোগে ভুগতে থাকবে? হ্যাঁ, এটি তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে DNA হলো মানুষ তৈরির নকশা।
————————————————————————–
আপনি যখন আপনার মোবাইল ফোন থেকে ফেসবুক আইকনে ক্লিক করেন তখন ফেসবুকের নিউজ ফিড দেখা যায়। আবার আপনার কম্পিউটার থেকে যখন This PC আইকনে ক্লিক করেন, তখন আপনার পিসির বিভিন্ন ড্রাইভ দেখা যায়। কিন্তু মোবাইল বা কম্পিউটার কীভাবে জানবে যে এই জায়গায় ক্লিক করলে কী দেখাতে হবে? এটা সম্ভব হয় কারণ- কোন বাটনে ক্লিক করলে কী করতে হবে সেটা কম্পিউটার বা মোবাইলকে আগে থেকেই বলে দেওয়া থাকে। যারা কম্পিউটারের সফটওয়্যার বা মোবাইল ফোনের অ্যাপ বানান, তারা আগে থেকেই লক্ষ লক্ষ লাইন কোড লিখে রাখেন। এই কোডগুলোর মাধ্যমে কম্পিউটার বা মোবাইলকে বলে দেওয়া থাকে যে কখন কী করতে হবে। শুধু Windows 10 তৈরি করতেই লেগেছে প্রায় ৫০ মিলিয়ন লাইন কোড!
একটি মানুষের শরীরে রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার বিলিয়ন কোষ। কিন্তু এত্ত বড় একটি মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র একটি কোষ দিয়ে। এই একটি কোষ মাত্র ৯ মাস সময়ের মধ্যে নিজে নিজেই ভাগ হয়ে হয়ে মায়ের পেটের মধ্যে আস্ত একটি মানুষে পরিণত হয়। এই কোষগুলো আবার সব একই রকম নয়। কিডনির কোষ একরকম তো, লিভারের কোষ অন্য রকম। আবার নতুন যে মানুষটি তৈরি হয় সে দেখতে-শুনতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার বাবা মায়ের মতো হয়। বাবা মায়ের কোনো জটিল রোগ থাকলে সেটাও অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের হয়ে যায়। যে একটি কোষ থেকে হাজার বিলিয়ন কোষের একটি মানুষ তৈরি হয়, সেই অতিক্ষুদ্র কোষটি এতকিছু জানতে পারে কীভাবে? এখানেও রয়েছে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মত একটি ব্যবস্থা। শুধু মায়ের পেটের সেই কোষই নয়, মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের মধ্যেই রয়েছে প্রায় তিন মিটার লম্বা একটি প্যাঁচানো অণু। এই অণুটিকেই বলা হয় DNA। এই DNA এর মধ্যেও এক ধরনের কোড রয়েছে। মানুষের একটি DNA এর মধ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে 6 বিলিয়ন কোড । আপনার গায়ের রঙ কি, আপনার উচ্চতা কত, ভবিষ্যতে আপনার কি কি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা আপনার DNA দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব।
DNA কে আপনি চাইলে কম্পিউটারের কোডের সাথে তুলনা করতে পারেন। আপনার চোখ কি কালো রঙের হবে, নাকি বাদামি রঙয়ের হবে- তা এই DNA কোডের মধ্যেই লেখা থাকে। DNA এর যেসব অংশের মধ্যে এইসব নির্দেশ বা কোড লেখা থাকে সেই অংশগুলোকে বলা হয় জিন। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ DNA এর খুব সামান্য অংশই জিন। এই জিন অংশ বাদে বাকি যে কোডগুলো রয়েছে বিজ্ঞানীরা এতদিন এই কোডগুলোকে অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন।
কিন্তু বিগত কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে- এই অংশগুলো মোটেই অপ্রয়োজনীয় নয়। বরং এই অংশগুলোই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার মূল কাজগুলো করছে। আসলে আপনার আমার DNA এর মধ্যে শুধু এটাই লেখা থাকে না যে আপনার গায়ের রঙ কি হবে, উচ্চতা কত হবে। বরং আপনার বাবার শুক্রানু ও মায়ের ডিম্বানু থেকে কীভাবে জাইগোট তৈরি হবে, আর সেই এককোষী জাইগোট থেকেই কীভাবে আপনার আমার মতো ট্রিলিয়ন কোষের ৬ ফুট লম্বা একটি মানুষ তৈরী হবে তার সবকিছুই লেখা থাকে এই DNA এর মধ্যে। কখন সেল ডিভাইডেশন হয়ে আপনি মোটা হবেন, আর কখন খেলেও মোটা হবেন না সেগুলো লেখা থাকে এই DNA এর জিনবিহীন অংশের মধ্যে। এই জিনবিহীন DNA কোডকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছিলেন JUNK DNA । কারণ বিজ্ঞানীরা তখন বুঝতেই পারেননি যে এই JUNK অংশটুকু মহা-গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আপনি দেখতে কেমন হবেন, সাইজে কেমন হবেন ইত্যাদি লেখা থাকে আপনার DNA এর জিন অংশের মধ্যে, অন্যদিকে দেহের ভেতরের কার্যকলাপ কীভাবে চলবে সেটা লেখা থাকে আপনার DNA এর JUNK অংশের মধ্যে। তাই জিন যদি তৈরি করে কম্পিউটারের গ্রাফিক্স, তবে JUNK অংশ হলো আপনার অপারেটিং সিস্টেম।
এই যে DNA এর মধ্যে আমাদের জীবনের সব কল-কাঠি লেখা রয়েছে তা কিন্তু কেউ ভালো দিনক্ষণ দেখে সেজে-গুজে লিখতে বসেনি। এই কোড তৈরি হতে সময় লেগেছে বিলিয়ন বছর। এর মধ্যে কিছু কিছু অংশ তৈরি হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। JUNK DNA বইয়ের লেখক একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে আমাদের JUNK DNA এর কিছু অংশ তৈরি হওয়ার তুলনা করেছেন।
বর্তমান ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল ১০৬৬ সালে। সে বছর নরমান্ডির (বর্তমান ফ্রান্সের একটি অংশ) ডিউক William the Conqueror ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধ জয়ী হয়ে সিংহাসনে বসেন। নরমানরা শুধু রাজ্যই জয় করেনি, তারা সেখানে বাস করতে শুরু করে, নিজেদের দেশ থেকে প্রচুর লোক ইংল্যান্ডে নিয়ে আসে এবং স্থানীয়দের সাথে মিশে যায়। একটি সময়ের পর এখন আর তাদের আলাদা করে নরমান বলে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। স্থানীয় এবং নরমানরা মিলে মিশে এক নতুন জাতির জন্ম দেয়। সেই জাতিকেই এখন আমরা ইংরেজ জাতি বলি।
আমাদের DNA এর ক্ষেত্রেও ঠিক এমন অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে আমাদের DNA এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির জীবের DNA প্রবেশ করেছে। এরপর সেগুলো প্রচুর পরিমানে ফটোকপি হয়েছে, কিছু অংশ বাদ পড়েছে, কিছু অংশ পরিবর্তিত হয়েছে, আর শেষ পর্যন্ত কিছু অংশ আমাদের DNA এর স্থায়ী অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। আমাদের DNA এর প্রায় ৪০ % তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন প্রজাতির জীবের DNA থেকে। এটা শুনে হয়ত অনেকের চোখ কপালে উঠতে পারে যে- আমাদের DNA এর প্রায় ৮% তৈরি হয়েছে রেট্রোভাইরাস নামে এক ধরনের ভাইরাসের কোড থেকে। মিলিয়ন বছর আগে এই ভাইরাসগুলো আমাদের দেহকে আক্রান্ত করেছিল। তারপর এখন তারা আমাদের অংশ হয়ে গেছে।
———————————————————————–
লেখক Nessa Carey বইটির নাম দিয়েছেন Junk DNA: A Journey Through the Dark Matter of the Genome । অর্থাৎ, তিনি JUNK DNA কে তুলনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের Dark Matter এর সাথে। বইটিতে তথ্য উপস্থাপনার ধরনটি অসাধারণ, যারা এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চান তারা নিঃসন্দেহে বইটি পড়া শুরু করতে পারেন। এই বইয়ের লেখক জিন, DNA, JUNK DNA ইত্যাদি বিষয় উদাহরণ দিয়ে দিয়ে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। লেখক নিজেই একজন গবেষক। তার নিজের গবেষণাসহ এই সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বইটিতে থ্রিলার সিনেমার মতো করে উঠে এসেছে । DNA এর Junk অংশের কোন কোড ঠিকঠাক না থাকলে কি ধরনের জটিল রোগ দেখা দিতে পারে এবং সেইসব রোগের এমন সব অদ্ভুত প্যাটার্ন হতে পারে যা জেনে অবাক হবেন। DNA যে সত্যিই মানুষ তৈরির নীল নকশা, তা এই বইটি পড়লে একদম ছবির মত স্পষ্ট হয়ে উঠে।