বিজ্ঞানী জ্যারেড ডায়মন্ড তার গবেষণার কাজে একবার পাপুয়া নিউগিনিতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তার সাথে কথা হয় স্থানীয় রাজনীতিবিদ ইয়ালির সাথে। কথায় কথায় ইয়ালি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল- তোমরা ইউরোপিয়ানরা এত এত প্রযুক্তি তৈরি করেছ, আর আমরা সেগুলো ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা কেন তেমন কোনো প্রযুক্তি তৈরি করতে পারিনি? তাহলে ইউরোপিয়ানরা কি আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান? জ্যারেড ডায়মন্ড একজন জিওগ্রাফার, পাশাপাশি তিনি একজন ইতিহাসবিদ। তাই এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই তিনি দেখলেন- এখানে চলে আসছে ইউরেশিয়ান মানুষদের উৎপত্তি, তাদের আধিপত্য, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বিভিন্ন ঘটনা।
ইয়ালির এই প্রশ্নটা শুনতে সাদামাটা মনে হলেও এর সঠিক উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবজাতির সুদূর অতীতে। তাই এই প্রশ্নের জুতসই একটা জবাব দিতে গিয়ে ডায়মন্ড আস্ত একটা বই লিখে বসেন! বিগত ১৩ হাজার বছরে মানবজাতি কীভাবে আজকের অবস্থায় আসলো? কেন পশ্চিমা সভ্যতা ও তথাকথিত উন্নত দেশগুলো সম্পদশালী, আর কেনই বা আফ্রিকা, লাতিন অ্যামেরিকা ও এশিয়ার বহু দেশ চরম দারিদ্র্যের শিকার? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ডায়মন্ড সেই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের সাহায্য নেন। প্রচুর তথ্য-প্রমাণ এবং ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে তিনি লিখেন ‘Guns, Germs and Steel’ নামে প্রায় ৫০০ পাতার এক বিশাল বই! এই বইটি বৈজ্ঞানিক, গবেষক এবং সাধারণ পাঠকমহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। জ্যারেড ডায়মন্ড এই বইয়ের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক ‘পুলিৎজার পুরস্কার’ পান।
যে তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ডায়মন্ড তার বই লিখেন সেটাকে বলা হয় ‘জিওগ্রাফিক্যাল থিওরি।’ এটাই মানবজাতির সভ্যতা তৈরি এবং অগ্রগতির ক্লাসিক্যাল বা ট্র্যাডিশনাল ব্যাখ্যা। কিন্তু এম.আই.টি.’র প্রফেসর ড্যারন অ্যাসেমগলু এবং আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জেমস এ. রবিনসনের মতে এই তত্ত্বে বড় একটা ফাঁক রয়েছে। এই দুই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ তাদের ১৫ বছরের গবেষণার উপর ভিত্তি করে ২০১২ সালে ‘Why Nations Fail’ নামে একটি বই লিখেন। প্রকাশের পর থেকেই এই বই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো- এই বইতে এই দুই অর্থনীতিবিদ লেখক জ্যারেন্ড ডায়মন্ড, জেফ্রে স্যাকস, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেভিড ফিশার, ম্যাক্স ওয়েবারের মত পৃথিবীর বিখ্যাত সব অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সবার তত্ত্বকেই বাতিল করতে চেয়েছেন। তাহলে কি আছে এই দুই অর্থনীতিবিদের তত্ত্বে- যা কিনা এইসব বড় বড় দিকপাল গবেষকদের থেকে আলাদা? একটি রাষ্ট্র তাহলে কেন ব্যর্থ হয়?
আপনি যদি রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং মানব জাতির অগ্রগতি নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী হন, তাহলে এই বই আপনার জন্য।
বেশিরভাগ তাত্ত্বিক একমত হয়েছেন যে, ১৬৪৮ সালের Westphalia শান্তিচুক্তির মাধ্যমেই মূলত আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা জন্ম নেয়। কিন্তু আজকের দিনে আমরা যে আধুনিক রাষ্ট্রে বসবাস করছি, তেমন রাষ্ট্র তৈরির জোয়ার শুরু হয়েছিল মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। তখন জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরির জন্য একটা উন্মাদনা তৈরি হয়। বড় বড় রাষ্ট্র ভেঙ্গে তখন ছোট ছোট জাতিরাষ্ট্র তৈরি হতে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো বেশ জটিল। এই জটিল কাঠামোর একটা ভালো ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য এই দুই অর্থনীতিবিদ মানবজাতির পুরো ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত- সভ্যতা ও আধুনিক বিশ্ব নির্মাণ করার প্রতিটি ধাপকে তাঁরা তুলে ধরেছেন এই বইতে।
চলুন তাহলে মানব সভ্যতার অগ্রগতির গভীরে প্রবেশ করা যাক।
————————————————————————–
আজ থেকে প্রায় ১৭০০০ বছর আগে পৃথিবীর আবহাওয়া নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায় প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শেষ হয় বরফ যুগ। এর আগের প্রায় ১ লক্ষ বছর পৃথিবী ছিল ভয়াবহরকম শীতল; গোটা স্থলভাগের ২৫ ভাগ তো ছিল রীতিমতো বরফের নিচে! কিন্তু এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রায় ১ হাজার বছর পর পৃথিবীর তাপমাত্রা আবার কমতে থাকে। এই ঠাণ্ডা পরিবেশ থাকে প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে। শেষ পর্যন্ত, আজ থেকে ১১,৬০০ বছর আগে তাপমাত্রা আবার বাড়তে থাকে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তাপমাত্রা বেড়ে বেশ আরামদায়ক উষ্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। তারপর থেকে আর কোনোদিন পৃথিবীতে সেই ভয়াবহ বরফযুগ আসেনি।
এই উষ্ণ আবহাওয়ার ফলে বরফ গলে পৃথিবীর বিশাল একটা অঞ্চল বরফের নিচ থেকে বের হয়ে আসে। আর এই উষ্ণ আবহাওয়াতে জন্মাতে থাকে প্রচুর গাছপালা, বাড়তে থাকে পশু-পাখির সংখ্যা। একই সাথে দ্রুত বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যাও। এই সময়টাতে মানুষ মূলত পশু-পাখি বা মাছ শিকার করা, বন্য ফলমূল এবং মধু সংগ্রহ করে জীবনযাপন করত। এই ধরণের মানব সমাজ “হান্টার গ্যাদারার” বা শিকারি-সংগ্রহজীবী নামে পরিচিত। এই শিকারি-সংগ্রহজীবীরা ছিল মূলত যাযাবর। এক জায়গায় এরা বেশিদিন বাস করত না। নতুন এই উষ্ণ আবহাওয়াই মূলত শিকারি জীবন ছেড়ে কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল।
কৃষিকাজের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। মধ্যপ্রাচ্যের যে এলাকায় প্রথম কৃষিকাজ শুরু হয় তাকে বলা হয় Hilly Flanks। আজ থেকে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে একদল লোক বর্তমান ফিলিস্থিনের জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে এবং সিরিয়ার তেল আসওয়াদ অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু করেছিল। এই লোকগুলোকে বলা হয় নাটুফিয়ান সংস্কৃতির লোক। ওরা গম, মটর, মসুর ডাল সহ আরও কিছু শস্য চাষ শুরু করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নাটুফিয়ানরাই কেন প্রথম চাষাবাদ শুরু করেছিল? অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন যে, ঐ অঞ্চলটাতে আসলে এই বু বন্য শস্যগুলো প্রচুর পরিমাণে ছিল, তাই নাটুফিয়ানরা চাষাবাদ শুরু করতে পেরেছিল। আসলে তখন ইউরেশিয়ার বিশাল অঞ্চল জুড়েই এইসব বন্য প্রজাতির ফসল ছিল। ব্যাপারটা এমন না যে, শুধু হিলি ফ্লাঙ্ক অঞ্চলেই এই শস্যগুলো পাওয়া যেত। এখানে আসল কারণটা হলো- নাটুফিয়ানরা প্রথমে ‘সিডেনটারি লাইফ’ বা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল, আর তারপর কৃষিকাজ শুরু করেছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, কৃষিকাজ শুরু করার আগেই ওরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০০ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১১৫০০ বছর আগে নাটুফিয়ানরা স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে। এরপর প্রায় ৫০০ বছর ওরা একই জায়গায় বসবাস করলেও তখনও কৃষিকাজ শুরু করেনি। কৃষিকাজ শুরু করার আগে ঐ ৫০০ বছর ওরা শিকারি জীবনযাপন করেছিল। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে আবু হুরায়রা নামক এক গ্রামে নাটুফিয়ানদের একটি বসতি পাওয়া গেছে। চাষাবাদ শুরু করার আগে ওদের এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ এর মত।
কিন্তু নাটুফিয়ানরা কেন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল? যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ীভাবে বাস করার বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বেশ শক্তি খরচ হয়। তারপর ওদের সাথে বেশকিছু হাতিয়ার বা জমানো খাদ্য থাকে, সেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়াও বেশ কঠিন। ফলে দলের অনেকেই হয়ত স্থায়ীভাবে বাস করার ব্যাপারে রাজি হয়ে থাকবে। কিন্তু অনেকে রাজি থাকলেই কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না, দলে অনেকেই আবার এর বিরুদ্ধে থাকতে পারে। এজন্য হয় দলের সবাইকেই রাজি হতে হবে, নয়ত অন্য কেউ যদি তাদেরকে বাধ্য করে তবেই সেটা সম্ভব।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সিডেনটারি লাইফ বা স্থায়ীভাবে বসবাস করার যেমন কিছু সুবিধা আছে তেমনি কিছু অসুবিধাও আছে। সবচেয়ে বড় প্র্যাক্টিক্যাল অসুবিধা হলো, ঝগড়া বিবাদ মেটানো বা কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট। একটি যাযাবর দলের মধ্যে কনফ্লিক্ট মেটানোটা অনেক সহজ, এবং অনেক ক্ষেত্রে তা এমনিতেই সমাধান হয়ে যায়। কারণ, খুব বড় সমস্যা হলে দল ভাগ হয়ে যায়, আর সমস্যাও এমনিতে মিটে যায়। কিন্তু বসতি স্থাপন করে থাকলে সেখানে বিবাদ মেটানোটা খুবই জরুরি, এবং তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন। এজন্য দরকার নির্দিষ্ট নিয়মকানুন। বসতি স্থাপন করলে সহজেই দলের সম্পদ জমা হয়ে যায়। ফলে, সম্পদের মালিকানা বিষয়ক আরও কিছু স্পষ্ট ধারণা এবং নির্দিষ্ট নিয়মকানুন থাকাটাও দরকার। আর যখন সম্পদের মালিকানার মত বিষয় চলে আসে, তখন প্রয়োজন দলের নেতা বা অথোরিটির মত আরও কিছু বিষয়। অর্থাৎ, বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তখন মোটামুটি এক সেট সামাজিক আইন এবং স্ট্রাকচার দরকার।
একটি হান্টার গ্যাদারার দল কোথাও স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে চাইলে তাদের এই জিনিসগুলোর দরকার হবেই। কারণ, এছাড়া তারা একসাথে বসবাস করতে পারবেনা। আর এই জিনিসগুলো থাকলে এক সময় তৈরি হয় শ্রেণি বিভাজন। অন্যকথায়, তখন সমাজে এলিট ক্লাস বলে একটা আলাদা শ্রেণি তৈরি হয়। এরাই বসতির বিভিন্ন সম্পদের অধিকার কিভাবে ভাগ করা হবে এইসব নির্ধারণ করবে, কিছু প্রাথমিক নিয়ম তৈরি করবে, পাশাপাশি অন্যদের সম্পদের থেকেও ভাগ নেবে। হান্টার গ্যাদারার জীবন বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে হলে, খুব ছোট পরিসরে হলেও একটা রাজনৈতিক কাঠামো প্রয়োজন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য ঠিক তাই বলছে! কৃষিকাজ শুরু করার অনেক আগে থেকেই ওরা সামাজিক শ্রেণিবিভাগসহ একটি জটিল সমাজব্যবস্থা তৈরি করেছিল। এই বিষয়ে অনেক ধরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হলো ওদের কবর। এলিটদের কবরের সাথে বিভিন্ন ধরণের গয়নাসহ অনেক ধরনের মূল্যবান জিনিস পাওয়া গেছে। কিন্তু বাদবাকি সাধারণ মানুষের কবরে কিছুই ছিল না। এই জিনিসগুলোর মধ্যে কিছু জিনিস বসতি থেকে বেশ দূরের কিছু এলাকা থেকে আনা হত। কিছু জিনিস তৈরি করতে বেশ শ্রমও লাগত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে দেখা যায়, এইসব গয়না এবং অন্যান্য জিনিস পরিধান করা ছিল সামাজিকভাবে উঁচু শ্রেণিতে থাকার একটা চিহ্ন। তাছাড়া, এইসব জিনিসের ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রমাণও পাওয়া যায়। ফলে এইসব থেকে মুনাফাও পেত এলিট ক্লাস। ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক এলিট ছাড়াও ওদের মধ্যে কাল্ট ভিত্তিক ধর্মীয় পুরোহিত টাইপের একটা শ্রেণিও তৈরি হয়েছিল। অনেকগুলো নাটুফিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মোটকথা, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, কৃষিকাজ শুরু করার আগেই ওরা স্থায়ীভাবে বসবাস করত, এবং সেই সময়ই ওদের বেশকিছু সামাজিক আইন-কানুন ছিল। পাশাপাশি ছিল সামাজিক শ্রেণিবিভাগ। অর্থাৎ, নাটুফিয়ানদের সংস্কৃতি থেকে দেখা যাচ্ছে- স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য কৃষিকাজ বা পশুপালনটা জরুরি নয়। জরুরি হলো সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো। এইগুলো ছাড়া স্থায়ীভাবে বাস করা সম্ভব নয়। আর স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য ভৌগোলিক অবস্থানটাও মূল বিষয় নয়। কারণ, তখন ইউরেশিয়া জুড়েই একইরকম সম্পদ পাওয়া যেত।
আসলে ঐ বিশেষ সময়টাতে হান্টার গ্যাদারারদের স্থায়ীভাবে বসবাস করাটা একদমই বাস্তবসম্মত ছিল। কারণ অস্থায়ী গুহাতেও হান্টার গ্যাদারারদের খাদ্য জমা করার বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। আর তখন যেহেতু আবহাওয়া উষ্ণ ছিল, তাই চারদিকে ছিল প্রচুর শস্য এবং পশু। ফলে, নাটুফিয়ানরা হয়ত প্রায়শই বাড়তি খাদ্য পেয়ে যেত। একারণেই তারা গ্রাম তৈরি করে বসবাস শুরু করে। এভাবে বাস করার কয়েক প্রজন্ম পরে নিজেদের সুবিধার জন্যই তারা কৃষিকাজ শুরু করেছিল, শুরু করেছিল পশুপালন। কিন্তু সবকিছুর শুরু হয়েছিল মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো জন্মের মধ্য দিয়ে। এই কাঠামো ছাড়া একত্রে বেশি মানুষ বাস করা বাস্তবসম্মত নয়।
তবে কৃষিবিপ্লব এবং মানব সভ্যতা শুরুর যে ট্র্যাডিশনাল ব্যাখ্যা, সেই ব্যাখ্যা কিন্তু আলাদা। জ্যারেড ডায়মন্ড, জেফ্রে সাকসের মত বড় বড় সব তাত্ত্বিকের মতে- কৃষি বিপ্লব, সভ্যতার শুরু এবং মানবজাতির উন্নতির পেছনে সবথেকে বড় ভূমিকা রেখেছিল স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগেলিক অবস্থা। তাঁদের মতে এইসব সম্পদের কারণেই মানুষ প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, কৃষিকাজ এবং পশুপালনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ইত্যাদির জন্ম হয়। কিন্তু নাটুফিয়ানদের সংস্কৃতি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষ কৃষিকাজ শুরু করার আরও ৫০০ বছর আগে থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। অন্তত, নাটুফিয়ানদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে সেটারই প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে- প্রাকৃতিক সম্পদ নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনই হলো স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান। সামাজিক সংগঠন এবং সামাজিক শ্রেণিবিভাজন ধারণা ছাড়া স্থায়ীভাবে বাস করা সম্ভব নয়।
আমরা জানি, সভ্যতা তৈরি এবং তার অগ্রগতি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া সম্ভব নয়। যেমন, আজ থেকে সাড়ে আট হাজার বছর আগে ইউরোপে কৃষিভিত্তিক সমাজ শুরু হয়। এটা হতে পেরেছিল কারণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে কৃষকরা ইউরোপে মাইগ্রেট করেছিল। আর মাইগ্রেট করার সময় তারা মূলত নিয়ে গিয়েছিল তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো। কৃষির সব উপাদান তো ইউরোপেই ছিল। তাহলে কৃষকরা মাইগ্রেট করার পর কেন ইউরোপে কৃষিকাজ শুরু হলো? কারণ, এই শুরুর জন্য দরকার ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজের কাঠামো আর কৃষিকাজের জ্ঞান।
কৃষিকাজ শুরু করার পর ইউরোপের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো ছিল অন্যান্য অঞ্চল, যেমন আফ্রিকার থেকে আলাদা। আফ্রিকাতে গরম আবহাওয়া আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে ওরা কিন্তু সবার প্রথমে কৃষিকাজ বা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেনি। শুরু করেছিল নাটুফিয়ানরা। কারন ওদের ছিল সেই কাঠামো।
সামাজিক কাঠামোর কি গুরুত্ব সেটা এবার নিশ্চয়ই বোঝা গেল। কিন্তু সেই কাঠামোটার ধরণ কেমন, সেটার উপর নির্ভর করছে সেই সমাজ টিকে থাকার সম্ভাবনা। নাটুফিয়ানদের সংস্কৃতি কিন্তু টিকে থাকেনি। নাটুফিয়ানরা যে ধরণের সামাজিক এবং রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি গড়ে তুলেছিল সেটাকে বলা হয় Extractive Political Institutions। যখন একটা সমাজে শুধু অল্পকিছু এলিট লোকজন সুবিধা পেয়ে সম্পদের মালিক হয়, তখন সেই ধরণের রাজনৈতিক অবস্থাকে বলা হয় Extractive Political Institutions। এই ধরণের সামাজিক সংগঠনের একটা ভালো দিক আছে। সেটা হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে; অর্থাৎ, ক্ষমতার কেন্দ্রে অল্পকিছু মানুষ থাকে। ফলে, এই মানুষগুলো চাইলে বাকি লোকগুলোকে দিয়ে পরিশ্রম করিয়ে একটা উন্নয়ন শুরু করতে পারে।
তবে এই ধরণের ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে একটি হান্টার গ্যাদারার দলকে সেটেল ডাউন করার জন্য আদর্শ হলেও সেটা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বা টিকে থাকার অনুকূল নয়। নাটুফিয়ানরা এক্সট্রাকটিভ ইন্সটিটিউশন তৈরি করার কারণে তাদের সমাজ কলাপ্স করেছিল, এবং তাদের কোনো উত্তরাধিকার তারা রেখে যেতে পারেনি। ঠিক যে কারনে নাটুফিয়ানরা কলাপ্স করেছিল, সেই একই কারনে আধুনিক সময়ের সোভিয়েত রাশিয়াও কলাপ্স করেছিল। এই ধরনের এক্সট্রাকটিভ ইন্সটিটিউশন প্রাচীনকালের চেয়ে আধুনিককালে আরও অসুবিধাজনক হতে পারে।
আধুনিক রাষ্ট্রের ব্যর্থ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করার আগে আমরা আরও একটি প্রাচীন সভ্যতার উদাহরণ দেখব।
প্রাচীনকালে কৃষিকাজ যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি জায়গায়ই শুরু হয়েছিল তা কিন্তু নয়। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী প্রাচীন পৃথিবীর অন্তত ১১টি জায়গায় স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল অ্যামেরিকা মহাদেশ। বর্তমান মেক্সিকোতে আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে কৃষিভিত্তিক সমাজের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়ে এক নগর সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি এখন মায়া সভ্যতা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মায়ানরা প্রথম নগর তৈরি করেছিল প্রায় ২৫০০ বছর আগে। কিন্তু প্রথমদিকের এই নগরগুলো সফলতার মুখ দেখেনি। এর প্রায় ৭৫০ বছর পর মায়ানদের মধ্যে নতুন এক ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারা বিকাশ লাভ করে, এবং এর ফলে শুরু হয় মায়ানদের ক্লাসিক্যাল যুগ। এই ধারাটা ২৫০ থেকে ৯০০ সাল পর্যন্ত। এই সময়টাই ছিল মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই সময়ের মধ্যে ওরা খুবই সমৃদ্ধশালী ও জটিল এক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করেছিল।
কিন্তু এই উন্নত ও জটিল সভ্যতাও টিকে থাকতে পারেনি। পরবর্তী ৬০০ বছরে মায়ানদের এই ধারাটাও শেষ পর্যন্ত কলাপ্স করে। মায়ানদের সভ্যতা কোনো সাম্রাজ্য তৈরি হতে পারেনি। ওদের ছিল গ্রিকদের মত নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। এই নগরগুলোর নিজেদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ ছিল। ছিল আলাদা আলাদা সিলমোহর ও বর্ণমালা। ওদের ছিল প্রায় ৩১ টির মত আলাদা ভাষা। তবে এই ভাষাগুলো ছিল প্রায় একই ধরণের। ওরা বাণিজ্য শুরু করেছিল, এমনকি কোকোবিনের সাহায্যে ওরা মুদ্রারও প্রচলন করেছিল। অর্থাৎ, ওদের সামাজিক কাঠামো প্রায় আধুনিক সমাজের মতই জটিল পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
প্রতিবছর কি ঘটছে তা রেকর্ড রাখার জন্য ওদের ছিল বিশেষ এক ধরণের ক্যালেন্ডার। এর নাম ছিল ‘Long Count।’ এই জিনিসটা থাকার কারণে মায়া সভ্যতার অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে অনেক নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। মায়ানদের ছিল বেশ ভালো মানের সেচব্যবস্থা এবং স্থাপত্য প্রযুক্তি। কিন্তু মায়ানদের এই জটিল সভ্যতা তৈরি এবং দারুণ উন্নতির পেছনের কারণও ছিল সেই- Extractive Political Institutions। এটা নাটুফিয়ানদের থেকে অনেক জটিল এবং উন্নত। কিন্তু তবুও মূলগত দিক থেকে এটাও তৈরি হয়েছিল এক ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ভিত্তিক কাঠামোর উপর ভর করে। ফলে এখানেও অল্পকিছু এলিট শ্রেণিই বেশিরভাগ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত।
মায়াদের অর্থনীতি যেভাবে উন্নতি করেছিল তার সাথে মিল দেখা যায় আফ্রিকার Bushong দের সমাজের। দুই জায়গাতেই নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে বেশ ভালো অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়, কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই এই লাভের গুড় খেয়ে ফেলে অল্পকিছু এলিট শ্রেণির মানুষ। মায়ানদের ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হলো- ৩০০ সালের দিকে ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে, তখন ওরা অল্পকিছু প্রযুক্তিগত উন্নতি করে। কিন্তু এরপর সেচ ব্যবস্থাতে সামান্য উন্নতি করা ছাড়া ওরা আর কোনো নতুন জিনিস বা নতুন প্রযুক্তির দিকে এগোয়নি। ওদের সভ্যতা যেন ঐ জায়গাতেই থেমে গিয়েছিল!
ভালো অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে জনসংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু ঐ সময়টাতে ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া রুক্ষ হতে থাকে। ফলে ফসল উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু ওরা সেচ ব্যবস্থা উন্নত করার দিকে পরের দিকে আর তেমন একটা মনোযোগ দেয়নি। কারণ, একপর্যায়ে ওরা বিভিন্ন কুসংস্কারভিত্তিক কাজে অংশ নিয়ে বাস্তব প্রয়োজনে প্রযুক্তির দরকার এটা হয়ত ভুলে গিয়েছিল। ওদের সংস্কৃতিতে শুক্রগ্রহ বা শুক্রদেবতা ছিলেন যুদ্ধের দেবতা। ওরা এক পর্যায়ে আকাশে তারার অবস্থান দেখে যুদ্ধ করা শুরু করেছিল। এই যুদ্ধের কারণেই হয়ত এক পর্যায়ে ওদের সমাজ রাজা শূন্য হয়ে পড়েছিল। আর রাজা শূণ্য হওয়া মানেই হলো প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কাঠামোর অভাব। যে কাঠামোর উপর ভিত্তি করে ওদের কৃষির সম্প্রসারণ হয়েছিল, তারপর সেটা থেকে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখন আর সম্ভব নয়। এক পর্যায়ে যেভাবে ওদের উন্নতি হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই আবার অর্থনীতির আকার ছোট হতে থাকে, মানুষ কমতে থাকে। মায়া সভ্যতা কলাপ্স করে।
মায়া সভ্যতা কলাপ্স করার বেশ কিছু কারণ ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল খরা। খরা ছিল প্রাকৃতিক কারণ। খরার কারণেই খাদ্যাভাব দেখা দেয়, যা ধীরে ধীরে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় মায়ানদের। প্রাকৃতিক কারণ বাদ দিলে আমরা দুইটা বিষয় দেখতে পাব যার কারণে মায়া সভ্যতা টিকতে পারেনি। তার একটি হলো Extractive Political Institutions এবং আরেকটি হলো নতুন প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ না দেওয়া। আধুনিক রাষ্ট্রের আলোচনায় আমরা দেখতে পাব যে- এই দুইটি জিনিস উপস্থিত থাকলে একটি আধুনিক রাষ্ট্র কখনোই উন্নতি করতে পারে না। মায়া সভ্যতা এতই উন্নতি ও জটিল হয়েছিল যে তা প্রায় আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার মতই। প্রাচীনকালের এক সভ্যতা এত জটিল অবস্থায় পৌছে গেলে, তারা যদি প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ না দেয়, তবে সে সভ্যতা যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেই কলাপ্স করতে পারে।
নাটুফিয়ান এবং মায়ানদের সমাজের কলাপ্স থেকে বোঝা যায় যে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো একটি সভ্যতার উন্নতি এবং টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই বিষয়টা আরও ভালো বুঝা যায় অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজের একটি ঘটনা থেকে।
১০০ বছর আগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার Yir Yoront গোষ্ঠীর লোকেরা মূলত প্রস্তর যুগের পাথরের হাতিয়ার দিয়েই তাদের জীবন চালাত। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে স্টিলের কুঠারের প্রচলন হয়। সাধারণত নতুন প্রযুক্তি একটি জাতি বা সমাজকে উন্নতি এনে দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। এই স্টিলের কুঠার পাওয়ার পর এই আদিবাসীরা দেখল- এই নতুন কুঠার খুবই কাজের জিনিস। অল্প সময়েই খাবার সংগ্রহ করা যাচ্ছে। ফলে ওরা হয়ে গেল অলস। আদিবাসীদের মধ্যে ঘুমের প্রবণতা বেড়ে গেল। ফলে নতুন প্রযুক্তি পেয়ে উন্নতির বদলে হতে লাগল অবনতি!
এই ঘটনা থেকে এটা বুঝা যায় যে, উন্নতির জন্য নতুন প্রযুক্তি বা সম্পদের চেয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা সংগঠন বেশি জোরালো বেশি ভূমিকা পালন করে।
যেসব রাষ্ট্র দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রেখেছে এইসব রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বলা হয়, Sustainable Development বা “টেকসই উন্নয়ন”। টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করে যেতে হয়। এই দুই অর্থনীতিবিদ তাদের দীর্ঘ দিনের গবেষণায় দেখেছেন যে- একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন হয় প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন; আর এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য দরকার হয় ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির রিজার্ভ বা মেধাসত্ত্ব আইন।
একজন গবেষক যখন একটি নতুন জিনিস তৈরি করেন, বা একটি নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন তখন সেই জিনিসটার কৃতিত্ব সেই গবেষকে দেওয়া হয়। যদি একজন বিজ্ঞানী একটি ফল থেকে একটি ভিটামিন তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তবে সেই আবিষ্কারের কৃতিত্ব ঐ বিজ্ঞানীরা নামে নিবন্ধন করা হবে। পরবর্তীতে কোনো কোম্পানি যদি এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ভিটামিন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে, তবে লাভের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ঐ বিজ্ঞানীকে দিতে হবে। এই বিষয়টাকে বলা হয় পেটেন্ট রাইট, বা মেধাস্বত্ত্ব আইন। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে- একটি রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হবে কিনা সেটা এই পেটেন্ট রাইটের প্রয়োগের উপর নির্ভর করে।
একজন মানুষ যখন একবার কোনো আবিষ্কারের পেটেন্ট পেয়ে যায়, তখন সে চায় এই আবিষ্কারের ফল যেন তিনি আজীবন ভোগ করে যেতে পারেন। কিন্তু অন্য কেউ যদি ঐ জিনিসের থেকেও ভালো কোনোকিছু আবিষ্কার করে ফেলে, তাহলে কিন্তু তিনি আর ঐ পেটেন্ট থেকে কোনো আয় করতে পারবেন না। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে এই ঘটনাটা যেন না ঘটতে পারে সেই ব্যবস্থা করেন। যারা কোন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন, তারা অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর ধন সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েন। ফলে, এই প্রভাব খাটানো খুবই সহজ হয়। এখন, এই অবস্থা হলে তো প্রযুক্তির কোন অগ্রগতি হবে না। আর প্রযুক্তির অগ্রগতি না হলে টেকসই উন্নয়নও সম্ভব নয়।
তাই, টেকসই উন্নয়নের জন্য এমন একটা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন যেখানে কেউ এভাবে প্রভাব খাটাতে পারবে না। এমন একটি ব্যবস্থা হলো Pluralistic political institutions। এই রাজনৈতিক কাঠামো হলো Extractive Political Institutions এর ঠিক উল্টো। এই পদ্ধতিতে অল্পকিছু মানুষ তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য কোনোভাবেই প্রভাব খাটতে পারবে না। যা দেশের সর্বসাধারণের জন্য ভালো, Pluralistic রাজনৈতিক কাঠামোতে শুধু সেই সিদ্ধান্তটাই নেওয়া হয়।
এই প্লুরালিস্টিক রাজনৈতিক কাঠামো থাকলে সব সময় নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি হবে। কেউ যদি আগের প্রযুক্তির চাইতে ভালো প্রযুক্তি তৈরি করতে না পারে তবে আগের আবিষ্কারকই মেধাস্বত্ত্বের ফল ভোগ করবে। ফলে দেশের মেধাবী মানুষরা আগের প্রযুক্তির চাইতে ভালো প্রযুক্তি তৈরি করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যায়। পলিটিক্যাল ইকোনোমিস্ট Joseph Schumpeter এই বিষয়টার নাম দিয়েছেন ‘creative destruction’ । একটি রাষ্ট্রে যখন এই ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশন প্রক্রিয়াটা চলতে থাকে, তখন সেখানে নিয়মিত আরও উন্নতমানের প্রযুক্তি এবং পণ্য তৈরি হতে থাকে। একমাত্র pluralistic political institutions ই এই ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশনের গ্যারান্টি দিতে পারে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রে যদি pluralistic এর বদলে Extractive রাজনৈতিক কাঠামো থাকে তবে কোনভাবেই ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশনের মাধ্যমে বেটার টেকনোলজি এবং বেটার প্রোডাক্ট তৈরি করা সম্ভব নয়।
তবে এখানে আরেকটি কথা আছে। প্লুরালিস্টিক পলিটিক্যাল কাঠামোর পাশাপাশি ওই রাষ্ট্রে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণও লাগবে। কারণ, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কেন্দ্রীকরণ ছাড়া pluralistic political institutions আবার সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ফেলবে।
তার মানে একটি রাষ্ট্রে pluralistic political institutions লাগবে, পাশাপাশি লাগবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। এটা থাকলে তখন রাষ্ট্রে ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি হবে। এবং এই নতুন নতুন প্রযুক্তিই মূলত দেশের টেকসই উন্নয়ন ঘটাবে।
তাহলে একটি রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয়? যদি এই দুই অর্থনীতিবিদের তত্ত্বকে অল্পকথায় ব্যাখ্যা করি তাহলে বলা যায়- কোন এলাকার স্থানীয় সম্পদ যত বেশিই থাকুক না কেন, সেই সম্পদ দিয়ে আসলে একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি সমাজ বা দেশ টিকে থাকতে হলে তাদের প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হয়। আর এই উন্নয়নই একটি দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এনে দেয়। আর এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য যা সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয় তা হলো দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো। দেশে যদি সঠিক রাজনৈতিক কাঠামো না থাকে, আইনের প্রয়োগ না থাকে, তবে সেই দেশে অল্পকিছু মানুষ সুবিধা ভোগ করে ধনী হয়। আর এক পর্যায়ে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে পড়ে বা কলাপ্স করে। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো অনেক জটিল। একটি রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয় তা পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের ‘হোয়াই ন্যাশনস ফেইল’ বইটি ভালোভাবে পড়তে হবে।
এই দুই অর্থনীতিবিদ লেখক তাদের এই তত্ত্বটি দাঁড় করানোর জন্য প্রচুর উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। তাদের এই বইতে যেসব রাষ্ট্র বা প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার উদাহরণ রয়েছে সেগুলোর নাম লিখতে গেলেও প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠার বেশি শেষ হয়ে যাবে! বিশাল কলেবরের এই বই আপনাকে মানব সভ্যতার শুরু থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের ব্যর্থ ও সফল হওয়ার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরবে।
এখন অনেকেই হয়ত ভাবছেন ম্যাক্স ওয়েবার, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জ্যারেড ডায়মন্ডের মত তাত্ত্বিক কি তাহলে মানব সভ্যতা অগ্রগতির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন? আমি বলব না। ‘জিওগ্রাফিক্যাল থিওরি’ মানব ইতিহাসের আজ পর্যন্ত অগ্রগতি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু বিগত একশত বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখবেন এই তত্ত্বের প্রচুর ব্যতিক্রম রয়েছে। আর এই ব্যতিক্রমগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে এই দুই অর্থনীতিবিদের তত্ত্ব। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে দিলেও তা সেই উন্নয়নকে টেকসই করতে পারে না। আধুনিক পৃথিবীতে টেকসই উন্নয়নের একমাত্র উপায় সঠিক রাজনৈতিক কাঠামো এবং ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি তৈরি করা।