পিডগিন ভাষা কিভাবে ক্রিওল ভাষায় পরিণত হয় সেটা এক বিস্ময়। অনেক সময় কোনো একটা অঞ্চলে দুইটি আলাদা অঞ্চলের মানুষ এসে একসাথে বাস করতে থাকে। কিন্তু তারা যেহেতু দুইটি ভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে, তাই কেউই কারও ভাষার সাথে পরিচিত না। ফলে যোগাযোগ করাটা খুবই কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তার দুই ভাষা থেকে কিছু কিছু শব্দ মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ভাষা তৈরি করে। দুই ভাষার সহজ শব্দগুলো সহজেই অন্যরা শিখতে পারে। ফলে এক প্রজন্মের মধ্যেই একটা জগাখিচুরি মার্কা অদ্ভুত ভাষা তৈরি হয়। এই ভাষাতে কোনো গ্রামারের বালাই থাকে না। এই ধরণের ভাষাকে বলা হয় পিডগিন ভাষা। কিন্তু আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে। এই পিডগিন ভাষা বলা লোকগুলোর বাচ্চারা যখন বড় হয়, তখন তারা নিজেদের অজান্তেই সেই ভাষায় গ্রামার তৈরি করে ফেলে। বাচ্চারা হয়ত জানেও না তারা একটা ভাষার ব্যাকরণ তৈরি করে ফেলছে। নতুন প্রজন্মের এই ব্যাকরণযুক্ত ভাষাকে বলা হয় ক্রিওল ভাষা। অ্যামেরিকার লুইসিয়ানা প্রদেশের আফ্রিকান বংশোদ্ভুত মানুষরা সেই ১৭৯২ সাল থেকে ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ ভাষার মিশ্রনে তৈরি করা একটা ক্রিওল ভাষা ব্যবহার করে আসছে।
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একটি বাচ্চাকে যদি আপনি জন্মের পরপরই আফ্রিকা বা ইউরোপের একটি দেশে নিয়ে যান এবং সেই দেশের বাচ্চাদের সাথে স্কুলে ভর্তি করে দেন, তাহলে কী হবে? সে কি ঐ দেশের ভাষা শিখবে?
যদি বাচ্চাটির বাবা মা বাসায় বাংলায় কথা বলে, আর সে স্কুলে গিয়ে অন্য একটি ভাষা শিখে, তাহলে- বাচ্চাটি অনায়াসেই দুইটি ভাষাতেই কথা বলবে। কিন্তু আপনাকে এখন অন্য দেশের একটি স্কুলে ভর্তি করে দিলেই আপনি অনায়াসে সেই দেশের ভাষা শিখে ফেলতে পারবেন না। আপনাকে নিজের চেষ্টায় ভাষাটি শিখতে হবে। কিন্তু চেষ্টা করলেও বাচ্চাদের মত দ্রুত এবং নিখুঁত ভাষা শেখাটা আপনার জন্য খুবই কঠিন।
কিন্তু কেন এমনটা হয়? বাচ্চাদের মধ্যে কী এমন আশ্চর্য ক্ষমতা আছে যে তারা ভাষা তো শিখতেই পারে, এমনকি নিজের অজান্তেই গ্রামার তৈরি করে ফেলে! আসলে বাচ্চাদের মস্তিষ্কের এমন একটি অংশ সক্রিয় থাকে যার কারণে বাচ্চারা সহজেই অন্য একটি ভাষা শিখে ফেলতে পারে। নোয়াম চমস্কি এবং তার গবেষক দল এই বিষয়টার নাম দিয়েছেন, “ইউনিভার্সাল গ্রামার মেশিন”। এই ইউনিভার্সাল গ্রামার মেশিন বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুর্বল হতে থাকে। ফলে বেশি বয়সে ভাষা শেখাটা খুবই কঠিন কাজ।
মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী কেন ভাষা তৈরি করতে পারে না? সেটার কারণও আমাদের মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্কের একটা ইন্সটিক্ট বা সহজাত ক্ষমতা আছে। এই বিশেষ ক্ষমতার কারণেই প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষই ভাষা তৈরি করতে পারে। (FOXP2) নামে একটি জিন সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেই দেখা যায়। কিন্তু মানুষের এই জিনটি সবার থেকে একদম আলাদা। এই জিনটি মূলত ভাষা তৈরি করার সাথে জড়িত। এই জিনে সামান্য একটা মিউটেশন হলেই মানুষ আর ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। এই জিনে যাদের সমস্যা আছে, তারা গুছিয়ে বাক্য বলতে পারে না। তারা কি বলবে আপনি কিছুই বুঝতে পারবেন না, আবার আপনি যা বলবেন এরাও কিছু বুঝতে পারবে না।
মানুষের ভাষা সত্যিকার অর্থেই একটি বিস্ময়। ভাষা নিয়ে জানতে গিয়ে আপনি যত গভীরে প্রবেশ করবেন আপনি ততই অবাক হবেন।
কানাডার বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ এবং কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট স্টিফেন পিংকার মানুষের ভাষার কলকব্জা নিয়ে বিস্তারিত এই বইটি লিখেছেন। The Language Instinct: How the Mind Creates Language । এই বইটি আপনাকে আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তা এবং ভাষা তৈরি করার এক আশ্চর্য জগতে নিয়ে যাবে।