গত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিউজ আসতে থাকে যে- ব্যাঙ নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! আমাদের আশেপাশে যে কয়েকটি প্রাণী কম বেশি সব সময় চোখে পড়ে, তার মধ্যে ব্যাঙ একটি। তাই পরিবেশ থেকে ব্যাঙ হারিয়ে যাওয়ার খবরটা মোটেই স্বস্তিদায়ক না। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে – একটা জার্নাল তো তাদের হেডলাইন করে বসল- “উভচরের জগৎ থেকে যদি দেখা হয়, তবে কি আমরা কি সিক্সথ এক্সটিংশনের বা ছয় নম্বর গণবিলুপ্তির মাঝামাঝি চলে এসেছি?”
ব্যাঙ বিলুপ্তির এই খবরটা প্রথম আসে পানামা অঞ্চল থেকে। উত্তর আমেরিকার দেশ পানামার এল ভ্যালে শহরটি গোল্ডেন ফ্রগ নামে এক ধরনের ব্যাঙের জন্য বেশ বিখ্যাত। স্থানীয় লোকজনের কাছে গোল্ডেন ফ্রগ রীতিমতে সৌভাগ্যের প্রতীক। এক দশক আগেও এল ভ্যালের প্রায় আনাচে কানাচে এই ব্যাঙদের দেখা যেত। এরপর হঠাৎ করেই গোল্ডেন ফ্রগের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। শুধু গোল্ডেন ফ্রগই না, অন্য অনেক প্রজাতির ব্যাঙও যেন লোকালয় থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল- হয়ত শহর এলাকার কোনো বিষাক্ত কেমিক্যালের জন্য এমনটা হচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, জনশূন্য পরিচ্ছন্ন এলাকা থেকেও ব্যাঙ হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা এর কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছিলেন না । শেষে কোনো উপায় না দেখে পানামা শহরে ব্যাঙদের জন্য রীতিমতো একটি হোটেলই বানানো হল। এই হোটেলে রুম সার্ভিস, মেইড থেকে শুরু করে সব ধরণের সুযোগ সুবিধাই ছিল। সেচ্ছাসেবীরা নানা জায়গা থেকে বিপন্ন ব্যাঙ ধরে ধরে এনে এই হোটেলে রাখত।
অনেক গবেষণার পরে জানা গেলো সাইট্রিড নামে এক ধরণের ফাঙ্গাস মূলত এই ব্যাঙ বিলুপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী। মুশকিলের ব্যাপার হলো, এই সাইট্রিড ফাঙ্গাস পরিবেশে একবার ঢুকে পড়লে খুব সহজেই সবদিকে ছড়িয়ে পরে। এই ফাঙ্গাস থেকে মুক্তি পেতে হলে পুরো এলাকাকেই ফাঙ্গাস মুক্ত করতে হবে, যা একেবারেই অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো, সাইট্রিড ফাঙ্গাস হঠাৎ করে পরিবেশে এলো কী করে? অনেক গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে- ঠিক একই ধরণের ফাঙ্গাস আফ্রিকার কোনো কোনো প্রজাতির ব্যাঙের শরীরেও দেখা যায়। তবে ওই সব ব্যাঙের শরীরে এই ফাঙ্গাস কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু এই একই ফাঙ্গাস পানামা অঞ্চলের ব্যাঙের শরীরে হয়ে ওঠে মরণঘাতী। ধারণা করা হয়, আফ্রিকার কোনো ফাঙ্গাস আক্রান্ত ব্যাঙ জাহাজ বা অন্য কোনো উপায়ে পানামা অঞ্চলে চলে আসে এবং সেই আফ্রিকান ব্যাঙের শরীর থেকেই এই ফাঙ্গাস পরিবেশে ছড়িয়ে পরে। শুধু পানামাতেই না, পানামা ছাড়াও আরও অনেক অঞ্চলেই ছড়িয়ে পরে এই ফাঙ্গাস।
একবার ভাবুন তো কি ঘটে গেল? এক হিসেবে বলতে গেলে কিন্তু- ব্যাঙের পৃথিবীতে এখন কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। ব্যাঙরা বিবর্তিত হয়েছে শত শত মিলিয়ন বছর আগে। ব্যাঙরা যখন ব্যাঙ হয়েছিলো তখন মানুষতো ছাড়, পৃথিবীতে ডাইনোসরই ছিল না। কত শত মিলিয়ন বছরের সার্ভাইভাল রেকর্ড ব্যাঙের! আর সেই ব্যাঙই কিনা মুড়ি মুড়কির মতো মরে যাচ্ছে! ব্যাঙের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য দায়ী আর কেউ নয়, আমরা মানুষরাই। মানুষ প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে পৃথিবীর সকল প্রাণের টিকে থাকার সমীকরণ।
পানামা অঞ্চলের ব্যাঙগুলোকে বিলুপ্ত করার জন্য মানুষকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। কোনো বিশাল বনভূমি উজাড় করতে হয়নি, কোনো কলকারখানা থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছাড়তে হয়নি। শুধুমাত্র এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতে হয়েছে। মানুষের জন্য যা ছিল নির্দোষ যাত্রা, ব্যাঙের জন্য তা ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। মানুষ এভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, সজ্ঞানে বা অজান্তে, কত প্রানীর যে বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু পৃথিবী থেকে কোনো একটি প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াটা কী স্বাভাবিক? এখন দুনিয়া থেকে হরহামেশাই প্রাণী বিলুপ্ত হয়। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। তবে এখানে একটা কথা আছে। গত ৫০ বছরে যে হারে প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে তা স্বাভাবিক প্রাণী বিলুপ্তির থেকে প্রায় ২৫০ গুণ বেশি! পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা আপনাদেরকে বুঝতে হলে পৃথিবীর ইতিহাসটাকে একটু ফিরে দেখতে হবে। প্রায় চার বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে পৃথিবীতে পাঁচ বার বড় ধরণের ‘মাস এক্সটিংশন’ বা ‘গণবিলুপ্তি’ হয়েছে। প্রথম গণবিলুপ্তিকে বলা হয় লেইট অর্ডোভিসিয়ান মাস এক্সটিংশন। এটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৪৪৩ মিলিয়ন বছর আগে। এই সময় প্রায় ৮৫ ভাগ জলজ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পরের মাস এক্সটিংশন হলো লেইট ডেভোনিয়ান মাস এক্সটিংশন। এই ঘটনাটা ঘটে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন বছর আগে। এসময় প্রায় ১৯% ফ্যামিলি ও ৫০% গণ বিলুপ্ত হয়ে যায় দুনিয়া থেকে। এর পর ঘটে লেট পারিমিয়ান মাস এক্সটিংশন। ২০০ মিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া এই মাস এক্সটিংশন সবচেয়ে বড় মাস এক্সটিংশন। গোটা জীব জগতের প্রায় ৫৭% ফ্যামিলি, ৮৩% গণ, ৮১% জলজ প্রজাতি ও ৭০% স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায় এই মাস এক্সটিংশনে। লেট পারমিয়ানের ৫০ মিলিয়ন বছর পর ঘটে এন্ড ট্রায়াসিক এক্সটিংশন। প্রায় ৭৬% জলজ ও স্থলজ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় এই এক্সটিংশনে। আর সর্বশেষ মাস এক্সটিংশন হলো এন্ড ক্রেটাসাজ, যা ঘটে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। এই শেষ বিলুপ্তির ঘটনাতেই দুনিয়া থেকে ডাইনোসরেরা উধাও হয়ে যায়। এই ঘটনার সবথেকে বড় শিকারই ছিল আসলে ডাইনোসররা।
যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ভয়ের তা হলো- এইসব মাস এক্সটিংশনের সময় যে হারে প্রাণী বিলুপ্ত হতো, এখন প্রায় সেই হারেই প্রাণীরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে কী আমরা আরেকটি মহা গণবিলুপ্তির সাক্ষী হতে যাচ্ছি? এর আগে যে পাঁচটি বিশাল মাপের গণবিলুপ্তি হয়েছে সেগুলো হয়েছে পৃথিবীর পরিবেশের নাটকীয় কোনো পরিবর্তন, বিশাল কোনো উল্কাপিণ্ডের আঘাত, বা পৃথিবী জুড়ে বড় বড় সব আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। কিন্তু এইবার আমরা যে মহাবিলুপ্তির সাক্ষী হতে চলেছি সেই ঘটনার নায়ক বা খলনায়ক পৃথিবীতে ধেয়ে আসা কোনো উল্কাপিণ্ড বা বড় মাপের কোন আগ্নেয়গিরি নয়। ছয় নম্বর এই মহাবিলুপ্তির মেইন কালপ্রিট হলো আমরা মানুষেরা।
এই ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিখ্যাত জার্নালিস্ট এলিজাবেথ কোলবার্টের ২০১৬ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম “The Sixth Extinction: An Unnatural History”। বইটি বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়, পায় পুলিৎজার পুরস্কার। প্রথমে আমরা পানামা অঞ্চলের ব্যাঙ বিলুপ্তির যে ঘটনাটি জানলাম সেটা এই বইটি থেকেই নেওয়া। বইটির মূল বিষয় হচ্ছে- এই ছয় নম্বর এক্সটিংশনটি কোনো প্রাকৃতিক কারণে ঘটছে না, পুরোটাই মানুষের সৃষ্টি। মোট তেরটি চাপ্টারে বিভক্ত বইটি লেখিকার বহু বছরের গবেষণার ফল। আমাদের আজকের আলোচনা এই বইটি নিয়ে।
একটি প্রাণী বা কোনো উদ্ভিদ যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে- এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই মানুষের ছিলো না। সেই প্লেটো-অ্যারিস্টটলের সময় থেকে ধারণা করা হতো যে- পৃথিবীর সবকিছু একটি পার্ফেক্ট ডিজাইন মেনে চলছে। এই ডিজাইনে কোনো প্রাণীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সম্ভব না। এমনকি পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রাণীর ফসিল পাওয়া যাচ্ছিলো, তখনও এই অ্যারিস্টটলীয় ধারণা থেকে বিশেষজ্ঞরা বের হতে পারেননি। বিলুপ্তি ধারণাটি সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা পায় অ্যামেরিকান মাস্টাডন নামে এক ধরণের হাতি নিয়ে ফ্রান্সের জীববিজ্ঞানী জর্জ কুইভারের গবেষণার ফলে। জর্জ কুইভারের গবেষণায় অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি সফলভাবে বিজ্ঞান মহলে প্রতিষ্ঠা করে যান।
জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন আমরা জানি যে- প্রকৃতি থেকে কোন প্রাণী বা একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বড় রকমের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াও প্রকৃতিতে প্রজাতি বিলুপ্ত হয়। এই ধরণের বিলুপ্ত হওয়াকে ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সটিংশন বলা হয়। আর মাস এক্সটিংশনের সময় প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার হার অনেকগুণ বেড়ে যায়। এই যেমন, বর্তমানে উভচর প্রাণী যেমন ব্যাঙ, স্যালাম্যান্ডারের বিলুপ্তির হার ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সটিংশনের চেয়ে প্রায় ৪৫০০০ গুন বেশি!
পৃথিবীতে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য মানুষ যেসব কাজ করে, তার সর্বপ্রথম কারণ হলো মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর। মানুষ যখন প্রথমবারের মতো অ্যামেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে পা রাখে, ঠিক তখন থেকেই ওই অঞ্চলগুলো থেকে বড় সাইজের ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়ে যেতে থাকে। এর সহজ কারণ, ওই অঞ্চলের ম্যামালরা কখনোই মানুষ দেখেনি। তাই মানুষ যে তাদের শিকার করতে পারে, এই ধরণের ইনটুইশন বা ধারণাই ওই প্রাণীগুলোর মধ্যে তৈরি হয়নি। মানুষ দেখে তাই ওই প্রাণীগুলো স্বভাবতই পালিয়ে যেতে, বা নিজেকে রক্ষা করার তেমন কোনো চেষ্টাই করেনি। এর ফলাফল স্বরূপ তারা মানুষের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে। কয়েক প্রজন্ম শিকারের ফলে আস্তে আস্তে ওই সব অঞ্চল থেকে বিগ ম্যামালরা চিরতরে হারিয়ে যায়।
মাত্র শ’খানেক বছর আগে ইউরোপ ও আমেরিকার একটা বিশাল এলাকা জুড়ে দেখা যেত গ্রেট অ্যাক পাখি। উটপাখির মত বিশাল সাইজের এই পাখিগুলো উড়তে না পারলেও, এরা ছিল বেশ দক্ষ সাঁতারু। আকারে বেশ বড় এবং সহজে শিকার করা যেত বলে গ্রেট অ্যাকরা জাহাজে ভ্রমণকারী নাবিক এবং যাত্রীদের খুব পছন্দের খাবার ছিল। ফলে যখন থেকে মানুষ স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল থেকে আইসল্যান্ডে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে, তখন থেকে লোকজন গণহারে গ্রেট অ্যাকের বাসস্থান এবং প্রজনন ভূমিতে আক্রমণ করতে থাকে। মানুষ যেহেতু গ্রেট অ্যাকের প্রাকৃতিক শিকারি না, তাই মানুষ দেখে গ্রেট অ্যাক তেমন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করত না। মাংসের এমন সহজ উৎস পেয়ে মানুষ স্বভাবসুলভভাবেই শিকারের লিমিট ক্রস করে ফেলে। এক সময় সারা ইউরোপ অ্যামেরিকা জুড়ে থাকা সেই গ্রেট অ্যাক বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। যখন মানুষ একটু সচেতন হয়ে ওঠে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। গ্রেট অ্যাক চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়।
বলতে গেলে পৃথিবীকে পুরোপুরি হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে মানুষ। নিমিষেই পাড়ি দিচ্ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, মানুষ তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নানা প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালাও নিজেদের সাথে করে নিয়ে যায়। এর ফলে আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণী বাস্তুসংস্থানে ঢুকে বাস্তুসংস্থানের পুরো ইকোয়েশনইটাই বদলে দিচ্ছে। আগ্রাসী প্রজাতির পরিমাণ এত বেশিই যে আপনি নিজেই বলতে পারবেন না, আপনার আশে পাশের কোনো গাছটা স্থানীয় আর কোন গাছটা ভিনদেশি। বাইরে থেকে আসা একটি প্রজাতি নতুন ইকোসিস্টেমে কিভাবে কাজ করবে তা বোঝা কঠিন। প্রায় ১০০ প্রজাতির মধ্যে কেবলমাত্র ৫ থেকে ১৫ টি নতুন পরিবেশে টিকে যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এদের মধ্যে একটি আবার হয়ে উঠতে পারে সর্বগ্রাসী। বিশেষ করে নতুন পরিবেশে ওর যদি কোনো ন্যাচারাল প্রিডেটর বা প্রাকৃতিক শিকারি না থাকে। ঠিক এমনটাই ঘটেছে বইগা ইরেগুলারিস নামে এক ধরনের বাদামি গেছো সাপের ক্ষেত্রে। বইগা পাপুয়া নিউগিনি ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রজাতির সাপ। এই সাপটি সম্ভবত মিলিটারি কার্গোর মাধ্যমে প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীন গুয়াম দ্বীপে আসে। গুয়ামে তখন মাত্র শুধু কেঁচো সাইজের একটি সাপই ছিল। এই অঞ্চলের আশেপাশে বইগাকে চেক দেয়ার মতো কোনো শিকারি না থাকায় বইগা সাপ লাগামহীনভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকতে পারে। এই বইগা সাপ গুয়ামের স্থানীয় সব ছোটখাটো পাখি অল্পের দিনের মধ্যেই সাবাড় করে দেয়। গুয়ামের তিনটি স্তন্যপায়ীর মধ্যে মাত্র এখন একটি প্রজাতি কোনোরকমে টিকে আছে।
আঠার শতকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মানুষ যে পরিমাণ কয়লা, গ্যাস ও তেল পুড়িয়েছে, তাতে করে ৩৬৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন পৃথিবীর বাতাসে যুক্ত হয়েছে। বনভূমি ধ্বংস করায় আরও ১৮০ বিলিয়ন মেট্রিক টন বাড়তি কার্বন বাতাসেই থেকে যায়। এখন প্রতিবছর বাতাসে ৯ বিলিয়ন টন কার্বন যোগ হচ্ছে, আর এই পরিমাণ প্রতিবছর অন্তর ৬ পারসেন্ট হারে বেড়েই চলছে। বিগত আট লক্ষ বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব বেশি। এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের দিকে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ শিল্পবিপ্লব হওয়ার আগে বাতাসে যে কার্বন ডাই অক্সাইড ছিল, তার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে! মাত্র কয়েকশত বছরের ব্যবধানে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এমন বৃদ্ধি, পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব রেখে চলছে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি দুইটি ঘটনার জন্ম দিচ্ছে- এক- গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দুই- ওশান অ্যাসিডিফিকেশন বা সমুদ্রের পানিতে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি। আর এই দুইটি কারণে পৃথিবীতে যে মাস এক্সটিংশন ঘটতে যাচ্ছে, তা গত পাঁচ বারের বিলুপ্তির থেকেও ভয়াবহ।
এটা আমরা প্রায় সবাই জানি যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থায় আছে শীতল এলাকার প্রানীগুলো। যেমন পোলার বিয়ার, সিল বা পেঙ্গুইন। তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলাফল কিন্তু আরও অনেক ভয়াবহ।
আমাদের পৃথিবী গরম ও ঠাণ্ডার একটা চক্রের মধ্যে থাকে। পৃথিবীর কক্ষপথের ঘূর্ণনের কারণে- পৃথিবী কয়েক হাজার বছর গরম অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হতে থাকে, আবার একটা সময় পর এই ঘূর্ণন উল্টে গেলে পৃথিবী আবার ঠাণ্ডা অবস্থা থেকে গরম অবস্থার দিকে যেতে থাকে। এই ঘটনা পৃথিবীতে ইতিমধ্যে ২০ বার ঘটেছে। প্রকৃতির এই গরম থেকে ঠাণ্ডা বা ঠাণ্ডা থেকে গরম হওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রাণীদের মাইগ্রেট করতে হয়, অর্থাৎ পৃথিবীর এক প্রান্তের প্রাণীরা বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। সুদূর সাইবেরিয়ার বাঘের মতো বাঘ যে আমরা সুন্দরবনেও দেখতে পাই এর কারণ এই মাইগ্রেশন। তবে পৃথিবীর ঠাণ্ডা থেকে গরম হওয়ার এবারের জার্নিটা একটু ভিন্ন। এইবার মানুষের কল্যাণে পৃথিবী দশগুণ বেশি দ্রুতগতিতে গরম হয়ে উঠছে। ফলে জীব বৈচিত্র্যকে টিকে থাকতে হলে স্বাভাবিকের থেকে আরও ১০ গুণ বেশি দ্রুতগতিতে মাইগ্রেট করতে হবে বা ১০ গুণ দ্রুতভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো- জীব বৈচিত্র্যের ঠিক কত অংশ এই দ্রুততর তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে পারবে?
পৃথিবী যেহেতু এখন ঠাণ্ডা থেকে গরম হওয়ার ফেইজে আছে, তাই প্রায় সব প্রাণীই ঠাণ্ডার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক বেশি বাড়তে থাকলে এই ঠাণ্ডা পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের জন্য টিকে থাকা বাড়তি চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেন বিবর্তনের নীতি অনুযায়ী ঠান্ডা পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্যের একটা বড় অংশ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।
এতো গেল গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফল। এখন দেখা যাক ওশেন অ্যাসিডিফিকেশনের ফলে কি ঘটতে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ জুড়ে আছে সমুদ্র। সমুদ্রের পানি বায়ুমণ্ডলের গ্যাস শোষণ করে আবার ছেড়ে দেয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সমুদ্রের এই গ্যাস শোষণ আর ছেড়ে দেওয়ার পরিমাণ মোটামুটি একইরকম থাকার কথা। কিন্তু পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যালেন্সটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রতি বছর প্রায় আড়াই বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড সাগরে শোষিত হচ্ছে। যার ফলে সাগরের pH কমে ৮.২ থেকে ৮.১ হয়েছে। pH মাত্র .১ কমে গেছে ভাবলে ভুল হবে। রিকটার স্কেলের মত pH ও লগাদরিমিক স্কেল। তাই .১ কমে যাওয়া মানে সাগর এখন অনেক বেশি অ্যাসিডিক। এই হারে চলতে থাকলে ২১০০ শতকের দিকে সাগরে pH এর মান গিয়ে নামবে ৭.৮ এ। আর এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। অ্যাসিডিটি বেড়ে গেলে সাগরের জীব বৈচিত্র নানা ভাবে হুমকির শিকার হতে পারে। প্রাণীদের পুষ্টি আহরনের মূল উপাদান আয়রন ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা যেতে পারে, সাগরে আলো ও শব্দ চলাচলের গতিপথ প্রভাবিত হতে পারে, এমনকি অর্গানিজমের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক ক্রিয়া যেমন মেটাবলিজম, এনজাইমের ক্রিয়া বা প্রোটিনের ফাংশন পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। যেসব প্রাণীর দেহে শক্ত শেল হয় যেমন ওয়েস্টার, মোলাস্ক, আর্চিনস এগুলো ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। কারণ শক্ত শেল হয় ক্যালসিয়াম কার্বনেট গঠনের মাধ্যমে। সাগর অ্যাসিডিক হয়ে গেলে এই ক্যালসিয়াম কার্বনেট গঠন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গবেষণায় দেখা গেছে pH এর মান ৭.৮ এ নেমে গেলে এক তৃতীয়াংশ প্রাণী একদম নিশ্চিতভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পেছনের ঘটে যাওয়া পাঁচ মাস এক্সটিংশনের অন্তত দুইটি এক্সটিংশন পারমিয়ান ও ট্রায়াসিক এক্সটিংশনে ওশেন অ্যাসিডিফিকেশনের হাত আছে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না ওশেন অ্যাসিডিফিকেশন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মতোই সমানভাবে এই মানুষের তৈরি মাস এক্সটিংশনে অংশ নিতে যাচ্ছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এই সিক্সথ মাস এক্সটিংশন কি ঠেকানো যাবে? যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ পরিবেশের এত ক্ষতি করে চলেছে সেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কী মানুষ পরিবেশের ক্ষতি রোধ করতে পারে না? কিছু কিছু পলিসির পরিবর্তন, কিছু কিছু পদক্ষেপ কিন্তু আশা জাগিয়ে তুলছে। মনে হচ্ছে মানুষ এই মহা দুর্যোগ রুখেও দিতে পারে। পরিবেশকে বাঁচাতে এখন অনেক মানুষই স্বেচ্ছায় নিরলস খেটে যাচ্ছেন। নিউ গিনির ব্যাঙের হোটেল তারই একটা প্রমাণ। ক্যালিফোর্নিয়া কনডোর নামে এক অ্যামেরিকান শকুন প্রায় বিলুপ্তির পথে যাচ্ছিল। আশির দশকে এর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ২৭ টিতে। তখন ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলোজিস্টরা একদম উঠে পড়ে লাগে ক্যালিফোর্নিয়া কনডোর এর বিলুপ্তি ঠেকাতে। তারা ডামি পুতুল ব্যবহার করে কনডোরের বাচ্চা বড় করতে, ইলেকট্রিক সাপ্লাই লাইনে শক যেন না খায় তার জন্য ট্রেনিং পর্যন্ত দেয়, ভ্যাকসিন দেয়। বায়োলজিস্টদের এই এফোর্ট বিফলে যায়নি। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার আকাশে শত শত কনডোরকে উড়তে দেখা যায়। জীব-বৈচিত্র্য বাঁচিয়ে রাখতে মানুষ নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং এই গবেষণার অনেক সুফলও পাচ্ছে। সিক্স এক্সটিংশনের একটা বিশাল বড় কারণ হলো কার্বন এমিশন। এই কার্বন এমিশনের কারণেই গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ওশেন অ্যাসিডিফিকেশন হচ্ছে। আমরা যদি ফসিল ফুয়েলের বিকল্প বের করতে পারি আর মাস লেভেলে তা ব্যবহার করতে পারি, তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সাগরে অ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়ার যে প্রেডিকশন করা হচ্ছে তা নাও ঘটতে পারে।
কিন্তু এক দিকে যেমন আশার আলো আরেক দিক তেমনি অন্ধকার। মানুষের অজ্ঞতা, দুর্নীতিপরায়ণতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও লোভ বরাবরের মতো রয়েই গেছে। ক্লাইমেট চেইঞ্জ খোদ অ্যামেরিকাতে একটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফসিল ফুয়েলের ব্যবসা করে ধনকুবের হওয়া অনেক লোক তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ যাতে ক্লিন এনার্জি ব্যবহার না করে। এই জন্য তারা পলিটিশিয়ানদের পকেটে রাখা থেকে শুরু করে মিডিয়াতে ক্লাইমেট চেইঞ্জ হোক্স প্রচার পর্যন্ত কোনো কিছুই বাকি রাখে নাই।
মানুষের ভবিষ্যত কি হবে তা এখনি বলা খুব কঠিন। তবে সিক্স এক্সটিংশন হোক বা না হোক, মানুষের গল্প থেমে যাক বা না যাক, পৃথিবীর, বিশেষ করে পৃথিবীর জীবনের গল্প বোধহয় খুব শিগগির শেষ হবে না। যেমন হয়নি গত পাঁচ এক্সটিংশনে। পৃথিবী আবার ভরে উঠবে নতুন জীব বৈচিত্র্যে, হয়ত মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী বিবর্তিত হবে। হয়ত আমরা এখনও কল্পনা করতে পারি না কোন সে প্রাণী বিবর্তিত হয়ে আবার পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। হয়ত তারা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরেও যাবে। কে জানে!