...

হোয়াটসঅ্যাপ : 01950-886700

ডেস্টিন্ড ফর ওয়্যার: ক্যান অ্যামেরিকা অ্যান্ড চায়না এস্কেপ থুসিডাইডস ট্র্যাপ

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন গ্রিসে তখন প্রধানত দুই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল। এর মধ্যে একটি হলো অলিগার্কি, আর অন্যটি হলো ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র। অলিগার্কি মানে অল্প কয়েকজন লোকের শাসন। এই অল্প কয়েকজন লোক হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে উঁচু বংশ এবং সম্পদশালী পরিবারের লোক। প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টা রাষ্ট্রে ছিল এই অলিগার্কি শাসনব্যবস্থা।

স্পার্টা মূলত যুদ্ধ এবং সামরিক শক্তির বিষয়েই তাদের বেশিরভাগ সম্পদ খরচ করত। স্পার্টা ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর রাষ্ট্র। স্পার্টার মতো আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল এথেন্স। এথেন্স আবার চলত ডেমোক্রেটিক বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এথেন্সের মূল ফোকাস ছিল সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার দিকে। এক পর্যায়ে এথেন্সও স্পার্টার মত শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে স্পার্টা ছিল প্রতিষ্ঠিত শক্তি, অন্যদিকে এথেন্স ছিল উঠতি শক্তি। এথেন্স সবে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং সে সময়ের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনি। একসময় গিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ “পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ” নামে পরিচিত। আর এই যুদ্ধের মাধ্যমেই গ্রিক সভ্যতার সোনালী যুগের ধ্বংস শুরু হয়ে যায়।

এথেন্সের সাথে স্পার্টার এই যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞই অনেক ব্যখ্যা দিয়েছেন। এদের মধ্যে গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিসের ব্যখ্যায় একদম মূল কথাটা উঠে আসে। তাঁর মতে, এথেন্স যে নতুন শক্তি হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল, এতে স্পার্টার ভয় হচ্ছিল। এথেন্স যেন স্পার্টাকে ছাড়িয়ে না যেতে পারে সে ব্যবস্থা করাটাই তখন স্পার্টার একমাত্র মাথাব্যথা।    স্পার্টার এই ভয় থেকেই দুই রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনাটা শুধু প্রাচীন গ্রিসেই সীমাবদ্ধ নয়। ইতিহাসে বার বার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

সেই উনিশ শতকের শুরুতে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “চীন ঘুমাচ্ছে, তাকে ঘুমাতে দাও। যদি এই ঘুম ভাঙে, সে পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিবে।” নেপোলিয়নের সেই কথার পর কেটে গেছে বহু বছর। এখন ২০২৩ সাল। চীনের ঘুম সত্যি ভেঙেছে। বর্তমান পৃথিবীতে শিল্প ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের চরম মুহূর্ত চলছে। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে আমরা স্পার্টা-এথেন্সের মতো একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত শক্তি। অন্যদিকে চীন হলো উঠতি শক্তি। শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনের উত্থান ছিল আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নাটকীয়। এই নব্বইয়ের দশকেই চীন ছিল একটা গোবেচারা রাষ্ট্র। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের ভেতর চীন কৃষিপ্রধান সমাজ থেকে শিল্পোন্নত জাতিতে এবং বিশ্বের শীর্ষ শিল্প-উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে চীন এখন একটি মুখ্য চরিত্র।

চীনের এই বিস্ময়কর উত্থান তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই বিশ্ব শক্তির ভারসাম্যের এই বিশাল পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন একটি শক্তি। চীনের বিভিন্ন কার্যকলাপ থেকেই বুঝা যায় চীন নিজেও ক্ষমতার জন্য মরিয়া। নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার পথে যত প্রতিবন্ধকতা, সেসব কিছুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে কিংবা আগ্রাসী হুমকি দিতে চীন দ্বিধা করে না।

একটা নতুন রাষ্ট্র যখন নতুন করে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে তখন সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র তাকে হুমকি মনে করে। ধীরে ধীরে তারা যুদ্ধের দিকে ঝুঁকে পরে, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ এড়ানো যায় না। এই পরিস্থিতিকে বলা হয়, “থুসিডাইডস ট্র্যাপ”। আর এই থুসিডাইডস ট্র্যাপ আমাদের বলে দেয়, যখন কোনো উঠতি শক্তি প্রতিষ্ঠিত শক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন যুদ্ধই হলো সম্ভাব্য ফলাফল। চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডস হলেন এই তত্ত্বের প্রবক্তা। এই তত্ত্ব অনুসারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রও এখন সেই থুসিডাইসের ফাঁদে আটকা পড়েছে।

বর্তমান বিশ্বে আমেরিকার উপর চীনের ভূমিকা কী প্রভাব ফেলতে পারে তা এখনও দেখার বাকি আছে। রাজনৈতিক, বিশ্লেষকসহ বিশ্বের বড় বড় থিংক-ট্যাংকরা এই ভবিষ্যৎ আঁচ করার চেষ্টা করে চলেছে। এই ভবিষ্যৎকে আঁচ করতে চাইলে  আমাদের অতীতের আরও এমন ঘটনার উপর নজর দিতে হবে।

এজন্য আমরা চলে যাব বিশ শতকের জাপানে। জাপানের তখন সবেমাত্র শক্তিশালী দেশ হিসেবে উত্থান শুরু হয়েছে। তার আগে অর্থাৎ ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতিতে জাপানের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটে যা জাপানের অর্থনীতিকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছিল। ঐ সময় মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডোর ম্যাথিউ পেরি এদো উপসাগরে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জন্য গানবোট জাহাজের একটি বহর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে গিয়ে তিনি জাপানের সম্রাটকে বাণিজ্যের জন্য জাপান সীমান্ত খুলে দিতে কিছুটা জোরপূর্বকই রাজি করান। লোভী জাপান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মতো বড় বড় দেশের সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাথে পাল্লা দিতে ছুটে যায়। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে দেশটির জিডিপি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জাপান তখন কেবল বড় বড় দেশগুলোর সমান পদমর্যাদা অর্জন করেই সন্তুষ্ট হয়নি। জাপান তখন আশেপাশের অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারেরও প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছিল।

জাপানের প্রতিবেশী দেশ কোরিয়ায় যখন বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন জাপানের শক্তি প্রদর্শন করার সুযোগ আসে। তখন জাপান এবং চীন দুই দেশই সেখানে সৈন্য পাঠানোর সুযোগ নেয়। অতি শীঘ্রই তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে জাপান জয়ী হয়। ফলে কোরিয়া, তাইওয়ান এবং মঞ্চুরিয়ার নিয়ন্ত্রণ জাপানের হাতে চলে আসে। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে মঞ্চুরিয়াতে আবার রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ ছিল। ফলে এই ঘটনায় রাশিয়া স্বভাবতই নাক গলাতে আসবে। জাপান ঐ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ছয় দিন পর রাশিয়ার অনুরোধে ইউরোপ জাপানের উপর চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে। ফলে জাপান বাধ্য হয়ে মঞ্চুরিয়া থেকে সরে আসে। অবশ্য জাপান আশা করেছিল যে এই পদক্ষেপের ফলে রাশিয়া হয়ত কোরিয়াকে জাপানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু রাশিয়া স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার জানায়। রাশিয়া কোরিয়ায় একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল তৈরির প্রস্তাব দেয়। মঞ্চুরিয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে জাপান তখন নিজেদের জন্য ক্ষতি হিসেবে দেখা শুরু করে। এর ফলে জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে জাপানই জয়ী হয়।

জাপানের এই মনোভাব বিশ্ব-রাজনীতির ইতিহাসে আমরা বার বার দেখতে পাই। জাপানের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণেই সে তখন বিশ্ব দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। কিন্তু চীনের সাথে দ্বন্দ্বে রাশিয়া এবং ইউরোপের হস্তক্ষেপের ঘটনায় জাপান বেশ অপমানিত বোধ করে। এই ঘটনায় জাপানের যে মনোভাব দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে প্রভাব বিস্তার করা, আগ্রাসী ভূমিকা, প্রতিষ্ঠিত শক্তির হস্তক্ষেপে অপমানিতবোধ হওয়া- সবই একটি উঠতি শক্তির বৈশিষ্ট্য। আর এসব বৈশিষ্ট্য সামরিক আগ্রাসনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।

ঠিক একই ঘটনা লক্ষ করা যায় বর্তমান সময়ের চীনের মধ্যে। ঐ সময় জাপান যা যা করেছিল এবং জাপানের যে ধরনের মনোভাব ছিল তার সবই এখন চীনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। চীনের পাগলা ঘোড়ার মত অগ্রগতি চীনকে সেই একই অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বর্তমানের প্রতিষ্ঠিত শক্তি অ্যামেরিকার সাথে তার ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিরোধে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। কিন্তু এই বিরোধ আর প্রতিযোগিতা কোথায় গিয়ে থামবে? চীন আর অ্যামেরিকা কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে? চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন মূলত থুসিডাইসের ট্র্যাপের মধ্যে পড়ে গেছে। এই ট্র্যাপ থেকে বের না হতে পারলে আরেকটা বড় যুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো খুব কঠিন।

চীন-আমেরিকার এই থুসিডাইডস ট্র্যাপ নিয়ে ‘Destined For War: Can America and China Escape Thucydides’s Trap’ বইতে লেখক গ্রাহাম অ্যালিসন বিস্তর আলোচনা করেছেন। অ্যালিসন পরমাণু কৌশল, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং চীনা রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি মার্কিন সরকারের পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, চীন নীতি এবং সাইবার নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন বিষয়ে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কোন কোন ভাবে বিরোধে জড়াতে পারে, তার পরিনতি কি হতে পারে, বা এই বিরোধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হবে এইসব নিয়ে এই বইতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এজন্য লেখক পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের বিশ্লেষণ সবকিছুরই সাহায্য নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ভূ-রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী যে কারও এজন্যই এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.